শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৩ অপরাহ্ন

শিশুর কাঁধে বইয়ের বোঝা

মো: তোফাজ্জল বিন আমীন
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০২২
  • ১২৩ বার

সকালে বের হলেই সচরাচর শিশুর কাঁধে বইয়ের বোঝার দৃশ্য চোখে পড়ে। শিশুরা বইয়ের ভারে মাথা নুয়ে হাঁটছে, বাবা-মা আঙুল ধরে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বইয়ের ব্যাগ শিশুর কাঁধ থেকে সরছে না। অল্প বয়সেই তারা পিঠের ব্যথায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছে। অথচ বইয়ের বোঝা তাদের শারীরিক ও মানসিক গঠনকে দুর্বল করে দিচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলোতে বাড়তি বইয়ের বোঝা না থাকলেও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে বাড়তি বইয়ের চাপে শিশুরা দিশেহারা। রাজধানীর অলিগলি ও পাড়া-মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো এসব স্কুল গড়ে উঠেছে। শিশুরাও পড়ছে। কিন্তু বেশির ভাগ স্কুলে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও খেলাধুলার মাঠ নেই। একটি কক্ষ কিংবা দু-চারটি রুমে আলো-বাতাসহীন অবস্থায় দিনের বেলায় আলো জ্বালিয়ে পাঠদান করা হয়। এসব স্কুলের বিরুদ্ধে সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার নামে গলাকাটা ফি আদায় করার অভিযোগ উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বইয়ের বোঝার অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যাওয়া-আসায় শিশুরা মেরুদণ্ডের সমস্যায় ভুগছে। শিশুর সাফল্যের কথা বিবেচনা করে অভিভাবক কিংবা শিক্ষকমণ্ডলী হয়তো বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন না। অথচ এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের ভাষ্য হচ্ছে- শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভার বহন করলে তাদের পিঠ ও পায়ে ব্যথা হতে পারে, তারা বামন বা খর্বাকৃতির হয়ে যেতে পারে, হতে পারে আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিসের মতো জটিল রোগ। সুতরাং এসব সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে হলে শিশুর ব্যাগের বোঝা কমাতে হবে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য বাণিজ্য কিংবা অর্থ উপার্জন নয়; বরং একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ জাতি গঠন করা। কিন্তু আমরা সে জাতি গঠনে ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে আগামী দিনের জাতি গড়ার কারিগরদের কাঁধ থেকে বইয়ের বোঝা কমেনি; বরং বেড়েই চলেছে। বইয়ের ভারে তাদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এটি আমার কথা নয়। গত ১৬ অক্টোবর ছিল বিশ্ব স্পাইন বা মেরুদণ্ড দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘মেরুদণ্ড আপনার অমূল্য সম্পদ, মেরুদণ্ডকে সুস্থ রাখতে হবে’। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা বলেন, বিশ্বের ৫৪ কোটি মানুষ মেরুদণ্ডের সমস্যায় ভুগছে। আমাদের দেশে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ভারী ব্যাগ বহন করায় শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানের দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এ সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ এ রোগের চিকিৎসাসেবা নেয়। অথচ এসব রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২১২ জন, যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তা ছাড়া ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে এই রোগের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারছেন না।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত শিশুদের কাঁধে বইয়ের বোঝা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তারা শ্রেণী অনুসারে বইয়ের সংখ্যা নির্ধারণ ও শ্রেণিকক্ষ বইহীন করার জন্য পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করেছে। আবার কোনো রাজ্যে বাসা ও স্কুলে দুই সেট বই দিয়ে স্কুল ব্যাগহীন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। দেশটির ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের এক সুপারিশে বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের কাঁধে স্কুলব্যাগে মাত্র দু’টি পাঠ্যবই দেয়া যাবে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের স্কুলব্যাগে তিনটি বই দেয়া যাবে। শিশুদের স্কুলব্যাগে এর চেয়ে বেশি বই দেয়া হলে স্কুল ও অভিভাবক দু’পক্ষকেই জরিমানা এবং নোটিশ পাঠানোর বিধান রাখা হয়েছে। আমাদের দেশে ২০১৬ সালে মহামান্য হাইকোর্ট শিশুর কাঁধ থেকে বইয়ের বোঝা কমানোর জন্য একটি দিকনির্দেশনা দেন। ওই নির্দেশনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করা হয়। হাইকোর্টের রায়ে অভিভাবকরা একটু স্বস্তি পেয়েছিলেন, ভেবেছিলেন এই রায় কার্যকর হলে কোমলমতি শিশুদের বাড়তি বইয়ের বোঝা কিছুটা হলেও কমবে; কিন্তু ওই পর্যন্তই শেষ।
আমাদের স্কুলগুলোতে সভ্যতার ফুল ফোটানোর কথা; কিন্তু সভ্যতার ফুল ফোটানোর আগেই আমাদের শিশুরা বইয়ের ভারে অঙ্কুরে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে। স্কুলগুলোতে বই আর খাতার প্রতিযোগিতা চলে। কে কত বেশি বই সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। একটি স্কুলে প্রতিদিন ১২টি ক্লাস না হলেও কমপক্ষে সাতটি ক্লাস হয়। সে ক্ষেত্রে সাতটি বই, সাতটি খাতা, কলম, পানির বোতল, খাবারসহ প্রত্যেক শিশুকে একটি বিশাল ব্যাগ বহন করতে হয়। একেকটি ব্যাগের ওজন প্রায় শিশুর ওজনের কাছাকাছি। আমার মেয়ে রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তার ব্যাগ বহন করতে অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেছি। অথচ আমার মেয়েকে ছয় দিনই ভারী ব্যাগ বহন করতে হচ্ছে। প্রত্যেক স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী পার হলেই অনুমোদনহীন বইয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ফলে প্রত্যেক শ্রেণীতে সরকার অনুমোদিত বইয়ের বাইরেও স্কুলের চাপিয়ে দেয়া ১২ থেকে ১৩টি বই শিশুদের পড়তে হয়। এসব বই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কিছু স্কুল বই প্রকাশনা থেকেও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ তা দেখার যেন কেউ নেই। এনসিটিবি অনুমোদনহীন বই পড়ানোর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিলেও কার্যত ফলাফল শূন্য। আমাদের সন্তানদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য বই-খাতার চাপ কমানো জরুরি। শিশুর কাঁধে বইয়ের বোঝা কমানোর জন্য সরকার, অভিভাবক ও স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলীর সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেন শিশুর কাঁধ থেকে বইয়ের বোঝা সরে এবং শিশুরা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে বেড়ে ওঠে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com