রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০২ অপরাহ্ন

জাহান্নামের কঠিন আজাব

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ৮২ বার

জাহান্নাম শব্দটি আরবি। এর অর্থ শাস্তির জায়গা। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন পরীক্ষা নেয়ার জন্য, পরীক্ষা শেষে ফলাফল দেবেন হাশরের মাঠে। যারা আমলে সালেহ বা নেক কাজ করেছেন তাদের জায়গা চির সুখের জান্নাত। আর যারা দুনিয়ায় আল্লাহর হুকুম মতো চলেনি নাফরমানি করেছেন তাদের জায়গা হচ্ছে জাহান্নাম। ‘কখনো না! তারা নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়। তুমি কি জানো হুতামা কী? আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুন। যা অন্তরসমূহকে গ্রাস করে। তা তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। অতি উঁচু স্তম্ভসমূহে’ (সূরা হুমাজাহ : ৪-৯)।

পবিত্র কুরআনে আর কোথাও জাহান্নামের আগুনকে আল্লাহর আগুন বলা হয়নি। এখানে এই আগুনকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে কেবল এর প্রচণ্ডতা ও ভয়াবহতারই প্রকাশ হচ্ছে না; বরং এই সাথে এও জানা যাচ্ছে, দুনিয়ার ধনসম্পদ লাভ করে যারা অহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতায় মেতে ওঠে তাদেরকে আল্লাহ কেমন প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্রোধের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। এ কারণেই তিনি জাহান্নামের এই আগুনকে নিজের বিশেষ আগুন বলেছেন এবং এই আগুনেই তাকে নিক্ষেপ করা হবে।
দুনিয়ায় আগুন জ্বালানোর জন্য আমরা লাকড়ি ব্যবহার করে থাকি। আর জাহান্নামের আগুনের লাকড়ি কী হবে এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কিন্তু যদি তোমরা এমনটি না করো আর নিঃসন্দেহে কখনোই তোমরা এটি করতে পারবে না, তাহলে ভয় করো সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যা তৈরি রাখা হয়েছে সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য’ (সূরা বাকারা-২৪)।

আর জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের এ আগুন জাহান্নামের আগুনের ৭০ ভাগের ১ ভাগ। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ এক ভাগ দিয়ে শাস্তি দিলেই তো যথেষ্ট হতো। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘জাহান্নামের আগুন তোমাদের আগুনের তুলনায় ৬৯ গুণ বেশি উত্তপ্ত’ (মুসলিম-২৪৮৩, বুখারি-৩২৬৫)।

জাহান্নামের সংখ্যা : জান্নাত একটি আর জাহান্নামও একটি। সূরা হিজরের ৪৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এর সাতটি দরজা আছে প্রত্যেক দরজার জন্য এক একটি পৃথক দল আছে। তবে জান্নাত ও জাহান্নামের অনেক স্তর রয়েছে। জান্নাত শব্দটি কুরআনে এবং হাদিসে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে ওই সব স্তরের দৃষ্টিকোণ থেকে। যেমন বলা হয়েছে, জান্নাতের ১০০টি স্তর রয়েছে। প্রতি স্তরের মধ্যবর্তী দূরত্ব আসমান ও জমিনের মধ্যকার দূরত্বের মতো। সর্বোচ্চ হলো ফেরদাউস। তার উপরে হলো আল্লাহর আরশ। যেখান থেকে জান্নাতের নদীসমূহের উৎপত্তি হয়েছে। অতএব যখন তোমরা চাইবে, তখন ফেরদৌস চাইবে’ (বুখারি, ইবনে মাজাহ)।। সূরা হিজরের ওই আয়াতে জাহান্নামের সাত দরজা দিয়ে দরজাই বুঝানো হয়েছে। সহিহ হাদিসে জান্নাতের আটটি দরজা আর জাহান্নামের সাতটি দরজার কথা বর্ণিত হয়েছে (সহিহুল জামে, হা-৩১১৯)।

জাহান্নামের দরজা বা স্তরসমূহের নাম- ১. জাহিম ‘জ্বলন্ত আগুন’; ২. হুতামাহ ‘চূূর্ণবিচূর্ণকারী’; ৩. হাবিয়াহ ‘অতল গহ্বর’; ৪. লাযা ‘অতি উত্তপ্ত’; ৫. সাঈর ‘উজ্জ্বল অগ্নিক’; ৬. সাকার ‘আকারযুক্ত’; ৭. আন-নার ‘আগুন’।

জাহান্নামের গভীরতা : জাহান্নামের তলদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে অবস্থান করবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনো কোনো সাহায্যকারী পাবে না’ (সূরা নিসা-১৪৫)। জাহান্নামের সর্ব নিম্নস্তরকে বলা হয় ‘হাবিয়া’। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে বসে ছিলাম। হঠাৎ করে আমরা একটি বিকট শব্দ শুনতে পেলাম, তখন তিনি রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘তোমরা জানো এটি কিসের শব্দ?’ আমরা বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, ‘ইহা একটি পাথরের শব্দ যা ৭০ বছর আগে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর তা আজ জাহান্নামের তলদেশে গিয়ে পৌঁছল’ (মুসলিম)।

জাহান্নামিদের খাবার : যেসব লোককে আল্লাহ জাহান্নামে পাঠাবেন তাদের জন্য জাহান্নামে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে রেখেছেন।

১. গাদের মতো পানি : পাপিরা আজাব ভোগ করতে করতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়বে। তারা তখন পানি চাইবে। তখন তাদের গাদের মতো পানি দেয়া হবে। তা পান করা মাত্রই মুখমণ্ডল ঝলসে যাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পরিষ্কার বলে দাও, এ হচ্ছে সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে, এখন যে চায় মেনে নিক এবং যে চায় অস্বীকার করুক। আমি (অস্বীকারকারী) জালেমদের জন্য একটি আগুন তৈরি করে রেখেছি যার শিখাগুলো তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলবে, আমি জালেমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানি চাইলে তাদের দেয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানি, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে, এটি নিকৃষ্ট পানীয়! আর জাহান্নামের কত নিকৃষ্ট আশ্রয়’ (সূরা কাহফ-২৯)।

২. জাক্কুম : জাক্কুম এক ধরনের বিষধর বৃক্ষের ফল, যা জাহান্নামের তলদেশে উৎপন্ন হয়। এই ফল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এর দ্বারা জাহান্নামিদের শারীরিক কোনো উপকার হবে না; বরং জাক্কুম ফল খাওয়া মাত্রই জাহান্নামিদের শারীরিক যন্ত্রণা আরো অনেক বেড়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয়ই জাক্কুম গাছ পাপীর খাদ্য হবে, গলিত তামার মতো পেটে ফুটতে থাকবে। যে রকম ফোটে পানি। একে ধরো ও টেনে নিয়ে যাও জাহান্নামের মধ্যস্থলে, তারপর তার মাথার ওপর ফুটন্ত পানির আজাব ঢেলে দাও, স্বাদ গ্রহণ করো, তুমি তো সম্মানিত, সভ্রান্ত। এ সম্পর্কে তোমরা সন্দেহে পতিত ছিলে’ (সূরা দুখান : ৪৩-৫০)।

৩. গিসলিন : জাহান্নামিদের দেহ থেকে প্রবাহিত রক্ত ও পুঁজের সমষ্টিকে বলা হয় গিসলিন। এ গিসলিন হবে জাহান্নামিদের নিকৃষ্ট খাবার। এ ধরনের পচা খাবার দ্বারা জাহান্নামিদের ক্ষুধা মেটাতে চাইলেও ক্ষুধা মিটবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অতএব, আজকের দিনে এখানে তার কোনো সুহৃদ নেই। আর কোনো খাদ্য নেই ক্ষত-নিঃসৃত গিসলিন ছাড়া। অপরাধী ছাড়া কেউ এটি খাবে না’ (সূরা হাক্কাহ : ৩৫-৩৭)।

৪. হামিম : হামিম বলতে বুঝানো হয়েছে জাহান্নামের আগুনে ফোটানো উত্তপ্ত গরম পানি। এই পানি পান করার পর পেটের ভেতরে সব কিছু গলে যাবে। নাড়িভুঁড়ি তরল পদার্থের মতো গড়িয়ে পড়বে এবং চামড়া ঝলসে যাবে। ‘এবং যাদের পান করতে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি যা তাদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেবে’ (সূরা মুহাম্মদ-১৫)।

৫. দরি : জাহান্নামিরা যখন খাবার চাইবেন, তখন তাদের সামনে দরি নামক খাবার উপস্থিত করা হবে। এ দরি হচ্ছে এক ধরনের দুর্গন্ধময় বিষাক্ত কাঁটা। এর দ্বারা দোজখের বাসিন্দাদের ক্ষুধা নিবারণ হবে না। এর পরও দরিকেই খাবার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে জাহান্নামিদের। ‘তাদের জন্য কাঁটাওয়ালা শুকনো ঘাস ছাড়া আর কোনো খাদ্য থাকবে না। তা তাদেরকে পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুধাও মেটবে না’ (সূরা গাশিয়াহ : ৬-৭)।

৬. সদিদ : আখিরাতে কাফেরদের স্থায়ী ঠিকানা হবে জাহান্নাম। এখানে তারা অনন্তকাল জ্বলতে থাকবে। তাদের শরীর থেকে মাংস ও চামড়া বিগলিত হয়ে গড়িয়ে পড়বে। সেটি অত্যন্ত দুর্গন্ধ ও ঘন হবে। এই দুর্গন্ধময় পুঁজকে সদিদ বলা হয়। এ সদিদই জাহান্নামিদের খাবার হবে। ‘তাদের প্রত্যেকের জন্য পরিণামে জাহান্নাম রয়েছে এবং পান করানো হবে গলিত পুঁজ, যা সে অতি কষ্টে একেক ঢোঁক করে গলাধঃকরণ করবে এবং তা গলাধঃকরণ করা প্রায় সহজ হবে না। সর্বদিক থেকে তার কাছে আসবে মৃত্যুযন্ত্রণা; কিন্তু তার মৃত্যু ঘটবে না এবং এরপর কঠোর শাস্তি ভোগ করতে থাকবে’ (সূরা ইবরাহিম : ১৬-১৭)।

৭. গাসসাক : গাসসাক হচ্ছে অধিক ঠাণ্ডা পানি, যা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থাকার কারণে পান উপযোগী নয়। ‘এ হচ্ছে হামিম ও গাসসাক, অতঃপর তারা একে আস্বাদন করুক’ (সূরা সাদ-৫৭)।

জাহান্নামিদের পোশাক পরিচ্ছেদ : জাহান্নামিদের পোশাকের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আর সে দিন তুমি অপরাধীদের দেখবে তারা শিকলে বাঁধা। তাদের পোশাক হবে আল কাতরার এবং আগুন তাদের চেহারাসমূহকে ঢেকে ফেলবে’ (সূরা ইবরাহিম : ৪৯-৫০)।
সাঈদ ইবন জুবায়ের রা: বলেন, তামার তৈরি পোশাক যা উত্তাপ দিলে অত্যধিক গরম হয়। ‘এরা দু’টি বিবদমান পক্ষ, যারা তাদের রব সম্পর্কে বিতর্ক করে। তবে যারা কুফরি করে তাদের জন্য আগুনের পোশাক প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর থেকে ঢেলে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি। যার দ্বারা তাদের পেটের অভ্যন্তরে যা কিছু রয়েছে তা ও তাদের চামড়াসমূহ বিগলিত করা হবে’ (সূরা আল-হাজ : ১৯-২০)। ইবন আব্বাস রা: বলেন, তামার দ্রবীভূত উষ্ণ পোশাক (তাফসিরে ইবনে কাসির : ২/৫৪৫)।

লেখক : শিক্ষক, তানজিমুল উম্মাহ হিফজ মাদরাসা, নারায়ণগঞ্জ শাখা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com