বড়দিনের আনন্দ এবার মাটি হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রে। হাড় কাঁপানো শীত আর ‘বোম্ব সাইক্লোন’র আঘাত যেন জল ঢেলেছে উৎসবে। বরফ-তুষার আর কনকনে শীতে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এ ভূখণ্ড যেন এখন আস্ত ডিপফ্রিজ। জমাট বেঁধেছে গোটা দেশ। ফুটন্ত জল ছুড়ে মারলেও মুহূর্তেই বরফের দলা হয়ে ঝরে পড়ছে ভূমিতে।
শুক্রবার রাতে দেশটির ২০০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বয়ে যাওয়া ঘণ্টায় ৭০-৮০ মাইল বেগের বোম্ব সাইক্লোনের পর থেকে তাপমাত্রা ক্রমাগত কমছে যুক্তরাষ্ট্রে। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে শহরগুলো।
ফলে বড়দিন এবার অন্ধকারেই কাটাতে হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষের। দুর্ভোগ-ভোগান্তির এখানেই শেষ নয়। মধ্যপশ্চিম থেকে পূর্ব উপকূল পর্যন্ত ব্ল্যাকআউটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আরও ৬৫ মিলিয়ন মানুষ। ছুটির দিনে ভ্রমণ-দুর্দশার কবলে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ।
থমকে গেছে যোগাযোগব্যবস্থা। বাতিল হয়েছে হাজার হাজার ফ্লাইট। রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন। ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসের (এনডব্লিউএস) তথ্যানুসারে, তাপমাত্রা মাইনাস ৫৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের (মাইনাস ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) নিচে নেমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ অঞ্চলেই এমন হিম শীতল ঠান্ডা আবহাওয়া। যার মধ্যে নাতিশীতোষ্ণ দক্ষিণ রাজ্যগুলো রয়েছে। এমনকি মিশিগানের ছোট শহর ‘হেল’, শুক্রবার রাতে তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রিতে নেমে যায়। যেন আগাগোড়া বরফ শহর। স্থানীয় একজন জানান, আমরা একটা জমাট বাঁধা নরকে সময় কাটাচ্ছি। ঝড়ের কারণে উইসকনসিন, ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, মিশিগান এবং ওহাইও অঙ্গরাজ্যের কিছু অংশে ভারি তুষারপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ২০ কোটিরও বেশি মানুষ এখনো আবহাওয়া সতর্কতার অধীনে আছে।
শনিবার এনডব্লিউএস জানিয়েছে, হাড় হিম করা এই চরম আবহাওয়ায় সাড়ে ১২ লাখের বেশি বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যেই দেড় লাখের বেশি মানুষ শুক্রবার বিদ্যুৎহীন ছিল। ট্র্যাকার পাওয়ারআউটেজ.ইউএসের তথ্যানুসারে, কনকনে ঠান্ডা হাজার হাজার বিদ্যুৎহীন মানুষের জন্য একটি তাৎক্ষণিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলশিক্ষক এবং স্বেচ্ছাসেবক রোজা ফ্যালকন জানান, টেক্সাসের এল পাসোতে, মেক্সিকো থেকে আসা অভিবাসীরা গির্জা, স্কুল এবং একটি নাগরিক কেন্দ্রে উষ্ণতার জন্য জড়ো হন। তবে কেউ কেউ এখনো মাইনাস ১৫ ফারেনহাইটের নিচে তাপমাত্রার বাইরে থাকছেন। কারণ তারা অভিবাসন কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আশা করছিল।
এদিকে বৈরী পরিস্থিতিতে বিঘ্ন ঘটে যোগাযোগব্যবস্থায়। শুক্রবার প্রায় ৫,০০০ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। আরও ৭,৬০০টি ফ্লাইট বিলম্বিত হয়। রোববার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ফ্লাইটগুলোর পরবর্তী শিডিউল এখনো জানানো হয়নি। বাধ্য হয়ে বিমানবন্দরেই বড়দিন কাটাতে হয়েছে বেশিরভাগ যাত্রীকে। লস অ্যাঞ্জেলেসে আগত যাত্রীদেরও পোহাতে হয় দুর্দশা। ক্রিস্টিন লেরোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, ‘ভ্যাঙ্কুভার থেকে কোনো ফ্লাইট খুঁজে পাইনি। আমাকে আমার ভাইকে সিয়াটলে আসতে হয়। ডেনভারে যাওয়ার জন্য সিয়াটল থেকে একটি ফ্লাইট বুক করি। আমার সিয়াটলের ফ্লাইট বিলম্বিত হয়। তারপর ডেনভারের ফ্লাইট বিলম্বিত হয়। পরে আমি জানতে পারি আমার লাগেজও হারিয়ে গেছে।
ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস জানিয়েছে, রকি পর্বতমালার পূর্ব থেকে অ্যাপালাচিয়ান পর্যন্ত তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় প্রায় ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ঠান্ডা আবহাওয়া সতর্কতার সম্মুখীন হয়। এক প্রজন্মে এ ধরনের ঝড় সম্ভবত একবারই দেখা যায়। এই শীতকালীন ঝড়ের কারণে আবহাওয়া সতর্কতার মুখে রয়েছে প্রায় ২০ কোটির বেশি মানুষ। এই সতর্কতা এক উপকূল থেকে আরেক উপকূল পর্যন্ত, সর্ব দক্ষিণে মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্ত এবং সানশাইন রাজ্য ফ্লোরিডা পর্যন্ত জারি করা হয়েছে। সপ্তাহের শুরুতে যে ঝড়টি এসেছিল তা প্রায় নজিরবিহীন, প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার চওড়া এবং কানাডার কাছে গ্রেট লেক থেকে মেক্সিকান সীমান্ত বরাবর রিও গ্র্যান্ডে পর্যন্ত প্রসারিত। ঠান্ডায় সবচেয়ে মানবেতর জীবণ পার করছেন গৃহহীনরা।