বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মাঝে মধ্যেই অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেখা যায়। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রায়ই ব্যবসায়ী বা আমদানিকারকরা বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে থাকে। কিন্তু এর গভীরে তলিয়ে দেখলে এক অনন্ত রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়। দেখা যায়, এক ক্ষমতাধর সিন্ডিকেট কৌশলে বাড়তি চাহিদা বা অস্থির পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কোনো সময় সঙ্কট দেখা দিলে এই সুযোগ তারা আরো বেশিভাবে নেয়।
সা¤প্রতিক ডলার সঙ্কটের কারণে স্বাভাবিক আমদানি এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সুবিধা ভোগী একটি পক্ষ, বিশেষভাবে ব্যাংকের তহবিলের ওপর যাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তারাই এক তরফা আমদানির সুযোগ পাচ্ছে। আর এই সুযোগ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো হচ্ছে বাজারে। সরকারের দায়িত্ব থাকে, এ ধরনের বাজার কারসাজিকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু এই সিন্ডিকেট যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সাথে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী সর্বোচ্চ মহলের অদ্ভুত এক যোগসূত্র লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে তার মধ্যে প্রধান পণ্য হলো চিনি। এখনো ঢাকায় প্রতি কেজি চিনি ১১৫ টাকা থেকে ১২০ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। অথচ সর্বশেষ সরকার টিসিবির জন্য যে চিনি আমদানি করেছে তাতে চিনির আমদনি মূল্য পড়েছে ৫১ টাকা। আর সরকার সে চিনি ৯২ টাকায় কিনছে। অথচ বাংলাদেশের প্রতি কেজি সাদা চিনিতে যে শুল্ক/কর রয়েছে তা দাঁড়ায় ৩১ টাকার মতো। এ হিসাবে ৮২ টাকায় চিনি আসার কথা। বাকি ১৯ টাকা প্রতি কেজিতে সুবিধাভোগীর পকেটে যাচ্ছে বলেই মনে হয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ মূল্য বাংলাদেশে
দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে চিনির সবচেয়ে বেশি দাম বাংলাদেশে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতে চিনির গড় খুচরা মূল্য ছিল বাংলাদেশি টাকায় ৪৫ টাকা, পাকিস্তানে ছিল ৪৪ টাকা, নেপালে ছিল ৭৯ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ছিল ৮০ টাকা আর বাংলাদেশে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। প্রতিযোগী সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চিনির দাম বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো, চিনি থেকে বাংলাদেশে সরকার যতটা কর শুল্ক নেয় ততটা অন্য কোন দেশ নেয় না। বাংলাদেশে আমদানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রক শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর ও অন্য কর/ফি মিলে এখন প্রতি কেজিতে ৩২ টাকার মতো রাজস্ব সংগ্রহ করছে সরকার। এটি ভারতে প্রতি কেজি চিনির দামের ৭২ শতাংশের মতো। এর বাইরে রয়েছে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ। সহজভাবে বলা যায়, একজন গ্রাহক প্রতি কেজি চিনি কিনতে সরকারকে ৩২ টাকা দিচ্ছে। এর বাইরে ৫১ টাকা আমদানি মূল্য ধরা হলে বাকি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা যাচ্ছে এর বিপণনকারী ও সিন্ডিকেটের হাতে।
এক সময় চিনির বাজার ছিল ট্রেডিংনির্ভর। তখন চিনির বাজারে চট্টগ্রামের মোস্তফা গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ এবং বিএসএম গ্রুপের প্রাধান্য ছিল। পাশাপাশি ছিল, ঢাকার দুই আমদানিকারক মেঘনা ও সিটি গ্রুপ। চলতি শতকের শুরুতে চট্টগ্রামে প্রথম এস আলম গ্রুপ চিনির রিফাইনারি স্থাপন করলে চিনির ব্যবসা হতে ট্রেডিংনির্ভর আমদানিকারকরা ছিটকে পড়েন। পাশাপাশি চট্টগ্রামের বাইরে গড়ে উঠে মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ ও আবদুল মোনেম গ্রুপের চিনি পরিশোধন কারখানা। সরকার কাঁচা চিনি ও সম্পন্ন চিনির কর শুল্কের মধ্যে বেশ ব্যবধান রেখেছে রিফাইনারিগুলোর সুবিধার জন্য। প্রতি কেজি কাঁচা চিনিতে সরকারের শুল্ক সম্পন্ন চিনির চেয়ে ১০ টাকা কম। এর ফলে চিনি পরিশোধনাগারের মালিকদের সাথে প্রতিযোগিতায় ছিটকে পড়েছেন চিনি আমদানিকারকরা। এতে বাজারে অলির্গকোপলি তথা কতিপয় ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তারা চাইলে চিনির দাম ইচ্ছা মতো বাড়িয়ে দিতে পারেন। তারা সরকারের ক্ষমতাধরদের ২ টাকা সুবিধা দিয়ে ১০ টাকা বাড়িয়ে নিতে পারেন মূল্য। আর এই টাকা যায় সাধারণ মানুষের পকেট থেকে।
সাধারণভাবে দেখা যায়, মূল্য নিয়ে গণমাধ্যমে হইচই হলে এর মূলে দৃষ্টি না দিয়ে খুচরা বা পাইকারি বাজারে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান চালানো হয়। অথচ খুচরা ব্যবসায়ীরা চিনির মূল্য কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেন না। যারা নিয়ন্ত্রণ করেন সেই সব সিন্ডিকেটের প্রতি চোখ বন্ধ করে রাখা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হলো, মিলাররা একদিকে উৎপাদন কম করছেন; অন্যদিকে বাজারে অতিরিক্ত ডিও ছেড়ে ক্যাশ টাকা সংগ্রহ করে নিয়েছেন। ফলে মিল গেটে অনেকটা কাড়াকাড়ি অবস্থা। ফলে যারা ডিও’র বিপরীতে চিনি পাচ্ছেন তারা বাজারকে অস্থির করে রাখছেন। আবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে মিলে উৎপাদিত চিনি বাজারে ছাড়ার চাপ থাকায় সে ক্ষেত্রেও ২০ শতাংশ হাতে রেখে বাজারে ছাড়ার অভিযোগ রয়েছে।
বেসরকারিভাবে কেউ পরিশোধিত চিনি আমদানি করতে চাইলে মিলাররা সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপে এনবিআরকে প্ররোচিত করেন, পাশাপাশি মিলাররা দাম কমিয়ে দেন, ফলে ট্রেডিংনির্ভর পরিশোধিত চিনি আমদানি বন্ধই হয়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ ও সরকারি মজুদ চিনি বাজারে না ছাড়ার সুযোগও নিচ্ছেন মিলাররা।
চাহিদা সম্পর্কে বিভ্রান্তি
অন্য অনেক পণ্যের মতো বাংলাদেশে চিনির চাহিদা সম্পর্কেও রয়েছে বিভ্রান্তি। সরকারিভাবে বলা হয় চিনির চাহিদা হলো ১৮ লাখ টন। অথচ দুই লাখ টনের কাছাকাছি সরকারি মিলগুলোতে উৎপাদন হবার পরও সা¤প্রতিক বছরগুলোতে ২১-২২ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে গড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২১ লাখ ৫৯ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ২৩ লাখ ১৩ হাজার টন চিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি চিনি আমদানি হয়েছিল ২০১৮ সালে ২৬ লাখ টন।
মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) ফরেন অ্যাগ্রিকালচারাল সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ চিনি আমদানিকারক দেশ। সংস্থাটির গত এক দশকে (২০১১-২০) দেশে চিনি আমদানির চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দশকের শুরুতে দেশের বাজারে ১৫ লাখ ৩৭ হাজার টন চিনি আমদানি হয়েছিল। এরপর থেকে ধারাবাহিক উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গেছে চিনির আমদানি বাজার। ২০১৪ সালে দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো চিনি আমদানির পরিমাণ ২০ লাখ টন ছাড়ায়। ২০১৮ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি চিনি আমদানির রেকর্ড সৃষ্টি হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর তথ্য অনুসারে ধারণা করা যেতে পারে, ২৪ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে দেশে। এতে বলা যায়। চিনির ৯৫ শতাংশ চাহিদা আমদানিনির্ভর। এ কারণে আমদানি ব্যবস্থার ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে এর মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এই নিয়ন্ত্রণ দুভাবে হতে পারে। এক হলো, সরকারি মিলগুলোকে আখ থেকে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি কাঁচা চিনি আমদানির মাধ্যমে সারা বছর মিল চালু রাখার ব্যবস্থা করা। এতে ওভারহেড খরচের কারণে এখন ৫০ কোটি টাকার চিনি বিক্রি করে ২০০ কোটি টাকা খরচের যে অবস্থা বিভিন্ন চিনি কলে রয়েছে তা আর থাকবে না। এর মাধ্যমে এক দিকে পাঁচ লাখ আখ চাষি পরিবারকে সহায়তা দেয়া যাবে, যারা আখের দাম না পাওয়ায় তা চাষ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অন্য দিকে সরকারের ভর্তুকির ওপর চাপ কমবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বেসরকারি চিনি পরিশোধন কারখানা লাভ করতে পারলে সরকারি মিলগুলো লাভ না করার কোনো কারণ থাকে না।
এতে আরেকটি সুবিধা হলো বেসরকারি খাতের হাতেগোনা কয়েক ব্যক্তির সেক্টরের ওপর একতরফা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পাবে না। সরকারি বেসরকারি প্রতিযোগিতা ন্যায্যমূল্য নির্র্ধারণে ভূমিকা রাখবে। মালয়েশিয়ার সদ্য প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সরকার গঠনের এক মাসের মধ্যে সিন্ডিকেটের হাত থেকে মূল্য নিয়ন্ত্রণ বিশেষ একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ে নিয়েছেন। এতে নিত্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে মালয়েশিয়ায়।
সিন্ডিকেট পৃষ্ঠপোষকতার মূল্য কতখানি
বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা হলো, সরকারের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়া সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে। সরকার টিসিবির মাধ্যমে কম মূল্যে গ্রাহকদের নির্বাচিত পণ্য সরবরাহের জন্য ক্রয় করে। এই ক্রয় অনুমোদন করে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। মন্ত্রিসভা কমিটির বিগত সভায় বিনা টেন্ডারে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ২৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পরিমাণ চিনি আমদানি করতে ব্যয় হবে ১২৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এতে প্রতি কেজি চিনির মূল দাম হচ্ছে ৫১ টাকা ৩৬ পয়সা। কিন্তু নির্ধারিত এ দরে টিসিবির গুদাম পর্যন্ত চিনি পৌঁছাতে কেজিপ্রতি দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৯২ টাকা ৬৫ পয়সা (নয়া দিগন্ত, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২)। পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনসহ সমগ্র বাংলাদেশে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী নি¤œ আয়ের এক কোটি পরিবারের মধ্যে প্রতি মাসে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রির সরকারি নির্দেশনার আলোকে অনুমোদিত ক্রয় পরিকল্পনার বিপরীতে এই চিনি কেনা হচ্ছে। উন্মুক্ত দরপত্র আহŸানের মাধ্যমে এই পণ্য ক্রয় করার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের পূর্বে পণ্য সরবরাহ পাওয়া যায় না যুক্তি দেখিয়ে টেন্ডার ছাড়া এই চিনি সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এর অল্প ক’দিন আগে টিসিবির জন্য আরেকবার চিনি সংগ্রহ করার প্রস্তাব অনুমোদন দেয় সরকার। সে সময় ব্রাজিল থেকে প্রতি কেজি চিনি কেনা হয় ৫৩ টাকায়। আর এর সাথে ভ্যাট ও নিয়ন্ত্রক শুল্কসহ প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ে ৭৮ টাকা। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ থেকে ১২ হাজার ৫০০ টন পরিশোধিত চিনি কেনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করে। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১০ নভেম্বর ২০২২)
এ সময় চিনির দাম প্রতি টন ৫২৪ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সর্বশেষ ক্রয়ের সময় চিনির আন্তর্জাতিক দর ছিল ৪৮০ ডলার। বিশ্ব বাজারে বাড়তি দামের সময় যদি ৭৮ টাকায় চিনি পাওয়া যায় তাহলে এখন সেই চিনি কেন ৯২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এখান থেকে বড় একটি অংক যে সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট বের করে নিচ্ছে? তা বুঝতে গবেষণার প্রয়োজন হয় না। এই সিন্ডিকেট দেশের বড় বড় ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকায় তাদের এলসির জন্য ডলারের অভাব হয় না। অথচ সাধারণ ব্যবসায়ীরা ওষুধের কাঁচামালের এলসি খোলার জন্য পর্যন্ত ডলার পায় না ব্যাংক থেকে।
গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অনৈতিক, বেআইনি ও বেসামাল মুনাফা করে নিজেদের পকেট ভরেছে। এতে জীবন ধারণে চড়া দামে নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে দিশেহারা ভোক্তা। আমদানি পণ্য থেকে শুরু করে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়েছে লাগামহীন গতিতে। সরকারের যথাযথ তদারকি না থাকায় ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া মুনাফা লুটে নিয়েছে। অথচ যে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে, তার প্রভাব এখনই দেশে পড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংকগুলো এখন এলসি করতে রাজি হচ্ছে না। একটা জাহাজে কম করে হলেও ২৭ মিলিয়ন থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তিন মিলিয়ন ডলারের বেশি এলসি খোলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পরপর নয়টি এলসি খুলতে হচ্ছে। ডলার কিনতে হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকা দরে। ৮৪ টাকা দামে ডলার থাকার সময় পণ্যের এলসি করার পর অনেক ক্ষেত্রে যখন টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে তখন প্রতি ডলারে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। চিনির ঘাটতি প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের আরো বক্তব্য হলো, দেশে বছরে ২২ থেকে ২৫ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। গত বছর ২৪ লাখ টন চিনি আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত ১৮ লাখ টন চিনি আমদানি বা বুকিং দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ গত এক বছরে ছয় লাখ টন চিনি কম আমদানি হয়েছে। বাজারে চিনির দামে এর প্রভাব পড়ছে।
বিপন্ন চিনি শিল্পকে রক্ষা
চাষাবাদ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে চিনি শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। চিনিকলগুলোতে ১৮ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছাড়াও পাঁচ লাখ ইক্ষুপরিবারসহ প্রায় ৪৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চিনি শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এ শিল্প এখন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার অধীনে। চিনিকলের উপজাত নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। ঝোলাগুড় এবং ছোবড়া অন্য শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চিনিকলের গাদ ও বর্জ্যপদার্থ ‘স্পেন্টওয়াশ’ ব্যবহার করে দর্শনায় একটি জৈবসার কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।
বর্তমানে প্রায় চার লাখ একর জমিতে আখ চাষ করা হয় এবং এতে উৎপাদনের পরিমাণ ৭২ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ২২ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন ব্যবহৃত হয় চিনিকলে এবং অবশিষ্ট ব্যবহৃত হয় গুড় তৈরিতে। বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চিনি, এক লাখ মেট্রিক টন ঝোলাগুড় এবং চার লাখ মেট্রিক টন ছোবড়া তৈরি হয়। প্রতি একরে উৎপাদনের দিক থেকে প্রাপ্তি বাংলাদেশ সর্বনিম্নে। এখানে প্রতি একরে উৎপাদন মাত্র ১৫ মেট্রিক টন, অথচ কিউবায় ৩৬ মেট্রিক টন, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫ মেট্রিক টন, অস্ট্রেলিয়ায় ৫৫ মেট্রিক টন এবং হাওয়াই-এ ৭০ মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে চিনি আহরণের হারও খুবই কম, মাত্র ৭.৪ শতাংশ। পক্ষান্তরে, ইন্দোনেশিয়ায় চিনি আহরণের পরিমাণ হচ্ছে ৯ শতাংশ, কিউবায় ১২.৩ শতাংশ, হাওয়াই-এ ১২.৪ শতাংশ এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১৫.৬ শতাংশ। বিশ শতকের আশির দশকে এ শিল্পে সমগ্র শ্রমশক্তির ১৫ শতাংশ নিয়োজিত ছিল। সমগ্র খাদ্য শিল্পের ৩০ শতাংশ স্থাবর সম্পত্তি ছিল চিনি শিল্পের আওতায়। তখন দেশের চিনির চাহিদার বড় অংশ পূরণ করত স্থানীয় চিনি শিল্পগুলো। এখন বাংলাদেশ বিশ্বের মোট চিনির মাত্র ১.৫ শতাংশ উৎপাদন করে এবং বিশ্বের ১৩০টি চিনি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ৬৭তম।
পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া হলে চিনি শিল্পের সুদিন আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য চিনি শিল্পগুলোকে লাভজনক করার উদ্যোগ নিতে হবে। এই শিল্পের জনবল কাঠামোকে যৌক্তিক করার পাশাপাশি এর শিল্প কাঠামোকে কার্যকর উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সব চিনিকলে সারা বছর চিনি উৎপাদনের মতো পরিশোধনাগার করা যেতে পারে। এতে চিনি কলের পাশাপাশি আখচাষিরাও লাভবান হবে। আখ উৎপাদন এতে বিস্তৃত হবে। সেই সাথে, আখ থেকে চিনি আহরণের হার বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত গবেষণার উদ্যোগও নিতে হবে।