বিদায়ি বছরে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যে নাকাল ছিলেন সাধারণ ভোক্তা। চাল-ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, চিনি, লবণ, মাছ-মাংস, সবজিসহ সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে ক্রেতাদের বাড়তি টাকা গুনতে হয়। প্রধান অজুহাত ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। সঙ্গে যুক্ত হয় জ্বালানি তেল ও ডলারের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত এবং যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট এবং যথাযথ তদারকির অভাবে বাজারে পণ্যমূল্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে বেশি। যে কারণে ক্রেতাদের চড়া মূল্যে পণ্য কিনতে হলেও উৎপাদকরা ন্যায্যমূল্য পাননি। এ কারণে শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও ছিল আকাশছোঁয়া। এজন্য বছরের বেশির ভাগ সময় সাধারণ ক্রেতাদের সংসার চালাতে নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দেয়। এর মধ্যে বেশি কষ্টে ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের মানুষ।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘পণ্যের দাম বাড়াতে অসাধুরা সব সময় সুযোগ খোঁজে। বছরের শুরু থেকেই এটি অব্যাহত ছিল। বিদায়ি বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়েছে। অন্যান্য দেশে দুই থেকে তিন মাস পর যুদ্ধের প্রভাব পড়লেও দেশে ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে অজুহাত দেখিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। জ্বলানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পর আমদানি করা সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের দাম আজ বাড়লে আজই আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ার কথা না। সেই বাড়তি ডলারে আমদানি করা পণ্য দেশে এলে দাম বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উলটো। মূলত এসব ক্ষেত্রে সরকারসংশ্লিষ্টদের তদারকিতে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। যে কারণে ক্রেতাকে বাড়তি দরে পণ্য কিনতে হয়েছে। পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত সবজি কৃষক কম দামে বিক্রি করে দিলেও ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি নতুন বছরে অব্যাহত থাকলে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।’
চাল নিয়ে চালাকি : বছরজুড়ে চাল কিনতে ক্রেতার কপালে চিন্তার ভাঁজ ছিল। কারণ বিদায়ি বছরে বাজারে চালের কোনো ধরনের সংকট না থাকলেও মিল মালিকরা একাধিক সময় চালের দাম বাড়িয়েছে। জুনে মিলারদের কারসাজিতে দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে বাজার স্বাভাবিক রাখতে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। আমদানি শুরু হলে দেখা যায়, ডলারের কারণে ভারত থেকে আমদানি করা চালের দাম বেশি হয়। ওই সুযোগে আগস্টে মিলাররা সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ চাল নিয়ে চালাকির সব ফর্মুলা ব্যবহার করেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। প্রতি কেজি মোটা চাল ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। সরু চালের দাম দাঁড়ায় ৮৫-৯০ টাকা। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং জোরদারের সঙ্গে দুদফায় আমদানি শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্পমূল্যে ওএমএস শুরু হয়। এতে চালের দাম কমতে থাকে। তবে আবারও নভেম্বরে চাল তৈরিতে খরচ বাড়ার অজুহাতে ভরা আমন মৌসুমে নভেম্বরে প্রতি কেজি চালের দাম ৮-১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। যদিও চাল উৎপাদনের সরকারি তথ্য বলছে, টানা কয়েক বছর দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে।
ডালের দামে দিশেহারা মানুষ : বছর শেষে আমদানিনির্ভর পণ্য ডালের বাজারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নভেম্বর থেকে বাজারে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম। খুচরা বাজারে বিভিন্ন ধরনের ডালের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়তি ধরে বিক্রি হচ্ছে। বছর শেষে বাজারে প্রতি কেজি মসুর ডাল মানভেদে বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা, যা বছরের শুরুতে ৯০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রেহায় পায়নি সয়াবিন তেল : জুনে দেশের খুচরা বাজারে প্রথমবারের মতো সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। লিটার প্রতি বিক্রি হয় ২০৫-২১৫ টাকা। বেশি মুনাফার জন্য সয়াবিন তেলের বাজার চলে যায় সিন্ডিকেটের খপ্পরে। চক্রটি বাজার থেকে তেল একপ্রকার উধাও করে ফেলে। ভোক্তার পকেট কাটতে হাঁকানো হয় চড়া দাম। ক্রেতারা ১০ দোকান ঘুরে শেষ পর্যন্ত বেশি দামে তেল কিনতে বাধ্য হন।
চিনির দামেও সর্বকালের রেকর্ড : বিভিন্ন সময় দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ বন্ধ রেখে সংকট তৈরি করেছে কোম্পানিগুলো। সরকারও বারবার দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেটা কার্যকর হয়নি। বছরের শুরুতে এক কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা। বছর শেষে বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকা। সম্প্রতি সরবরাহ সংকটের অজুহাতে প্রতি কেজি চিনি ১৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এছাড়া প্রতি কেজি লবণ বিক্রি হয়েছে ৪২ টাকা, যা আগে ৩৫ টাকা ছিল।
আটার বাজারও অসহনীয় : ২০২২ সালের শুরুতে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। বছরের শেষদিকে বিক্রি হয় ৬০-৬৫ টাকায়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি আটা ৭০ শতাংশ এবং ময়দা ৫৭ শতাংশ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। বছরের শুরুতে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটার বাজারমূল্য ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। বর্তমানে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত ময়দার দাম ছিল ৫৫ টাকা। দাম বেড়ে এখন ৭৫-৮৫ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
ডিমের বাজারও অস্থির : জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ডিম ব্যবসায়ীরাও একহাত নিয়েছেন। পরিবহণ খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে হঠাৎ করেই ডিমের বাজারে অস্থিরতার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়। আগস্টে ঢাকার খুচরা বাজারে এক হালি (৪ পিস) ফার্মের ডিমের দাম ওঠে ৫০-৫৫ টাকা। দেশি হাঁস ও মুরগির ডিমের দর ছিল প্রতি হালি ৬৫-৭২ টাকা। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পাইকারি ডিমের আড়তদারদের কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাদের অনিয়ম ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি।
মাংসের দাম বাড়তি : কৃষিশুমারির তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে প্রায় ৩৭ লাখ ৭৪ হাজার গরু এবং ৩১ লাখ ২৬ হাজার ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশে গরু, ছাগল ও মুরগির কোনো সংকট নেই। চাহিদার তুলনায় বেশি। তারপরও দেশের বাজারে প্রতিবছরই মাংসের দাম বাড়ছে। বছরের শেষে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৭০০ টাকা। ৮০০ টাকার খাসির মাংস বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বছরের মাঝামাঝি সময় বিক্রি হয়েছে ১৯০-২১০ টাকা। রামপুরা বাজারের রিকশাচালক মকবুল বলেন, ‘এক কেজি গরুর মাংস ৭০০ টাকা। খেতে খুব ইচ্ছা করলেও কিনতে পারি না। যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষ মাংস খাওয়া ভুলে গেছি।’
এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। টুথপেস্ট থেকে শুরু করে সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডারসহ অন্যান্য ব্যবহার্য পণ্যের দামও এখন স্বল্প-আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফলে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগে বিদায়ি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন। তবে এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির নেই।
বিদায়ি বছরের মাঝামাঝি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে নতুন করে বিপদে পড়েছে ২৯ শতাংশ মানুষ। যেখানে বছরের শুরুতে দেশের ১৮ শতাংশ মানুষের জীবনমানের ওপর সেই চাপ ছিল। এখন বছর শেষে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি চাপ নিঃসন্দেহে আরও বেড়েছে।
ক্যাবের গোলাম রহমান মনে করেন, সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার তদারকি পরিচালনা করছে। নতুন বছরে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। সবকটি সংস্থার সমন্বয়ে বাজারে তদারকি করতে হবে। পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানি কত করতে হবে, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্য মাঠ থেকে বাজারে আসতে সব ধরনের বাধা দূর করতে হবে।
জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বছর বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজারে সার্বিক তদারকি করেছি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নিয়ে অধিদপ্তরে সভা করেছি। নানা অনিয়ম পাওয়ায় যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে জনবল সংকট ও আইনের দুর্বলতার কারণে অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখাও কষ্টকর। তাই ব্যবসায়ীদের আরও আন্তরিক হতে হবে। সব মিলে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নতুন বছরের প্রথম থেকেই তিন স্তরে তদারকি করা হবে। যাতে পণ্যের দাম নিয়ে কেউ অসাধুতা করতে না পারে।