শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:২০ পূর্বাহ্ন

ভোটারের আস্থা ফিরল না

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
  • ৩৩৭ বার

অতীতের পথ ধরেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি। বিতর্কিত নির্বাচনের সংস্কৃতি থেকে ঢাকা সিটি নির্বাচনও বের হয়ে আসতে পারেনি। যার কারণে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারেও তরুণসহ ভোটারদের আস্থা ফেরাতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সুশীলসমাজ ও স্থানীয় সরকার বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশা ও শঙ্কা দুই-ই ছিল। তবে নানা মহলে শঙ্কার দাগটাই ছিল মোটা। বড় ধরনের সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ ছাড়া এই নির্বাচন সম্পন্ন হলেও ভোটারের আস্থা ফেরানোর যে সুযোগ ইসির সামনে আবার এসেছিল, তারা তা কাজে লাগাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বিতর্কের মুখে ইভিএম ব্যবহারের কারণে ভোটারের অনিহা আরো বেশি ছিল। যারাই ভোট দিতে গেছেন তাদের কম-বেশি আঙুলের ছাপ না মেলায় বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে। এই ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার বাইরে সিইসি নিজেও নন। পাশাপাশি ভোট প্রদান ছিল অনিরাপদ। একজন ভোট দিয়ে যাওয়ার পরেও বেশি সময় ধরে ব্যালট ইউনিটে তার ভোটদান দৃশ্যমান থাকে। এতে পরবর্তী ভোটার দেখতে পান তিনি কোথায় বা কাকে ভোট দিয়েছেন। ফলে এই ইভিএম নিয়ে একটা শঙ্কা আরো বদ্ধমূল হলো।

এম হাফিজউদ্দিন খান : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের বিশ্লেষণ : বড় ধরনের কোনো রকম সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ ছাড়া এই নির্বাচন সম্পন্ন হলেও ভোটারের আস্থা ফেরানোর যে সুযোগ ইসির সামনে আবার এসেছিল, তারা তা কাজে লাগাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আমরা অনেকেই বলেছিলাম, এই নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কতটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশা আর শঙ্কা দুই-ই ছিল। শঙ্কার প্রতিফলন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছুটা হলেও দেখা গেছে।

ইভিএমের বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করে সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ইভিএমে অনেক ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলায় বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে এবং সিইসি নিজেও এর বাইরে নন। আমিও একজন ভুক্তভোগী। আমার এক প্রতিবেশীও এ কারণে ভোট দিতে পারেননি। এ রকম অভিযোগ আরো শুনেছি। তা ছাড়া ভোটারের উপস্থিতি প্রায় সব কেন্দ্রেই লক্ষ করা গেছে নগণ্য। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কেউ কেউ ভোটকেন্দ্রসহ ভোটের সার্বিক পরিবেশ অতীতের চেয়ে ভালো ছিল বলে দাবি করলেও বিভক্ত ঢাকা সিটির মেয়র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দুই প্রার্থী অনিয়মের অভিযোগ সকালবেলাতেই উত্থাপন করেন। তারা তাদের এজেন্ট লাঞ্ছিত হওয়াসহ বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাদের বের করে দেয়ার অভিযোগ করেছেন। ভোটের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আমার নিকটস্থ ভোটকেন্দ্রে যে চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি, তা প্রত্যাশিত ছিল না। শুধু ভোটারের হতাশাজনক অনুপস্থিতিই নয়, বিরোধী পক্ষের উপস্থিতিও কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ করিনি। একটি ভোটকেন্দ্রে সব পক্ষের এজেন্ট থাকবেন, কেন্দ্রের পাশে তাদের ক্যাম্প থাকবে, কর্মী-সমর্থকরা থাকবেন- এটিই খুব স্বাভাবিক। কিন্তুযা দেখলাম, সবই একপক্ষীয়।

অর্থাৎ আরেকটি ‘ভোট পরীক্ষা’র যে কথা সংবাদমাধ্যমসহ নানা মহল থেকে বলা হয়েছিল, এর ইতিবাচক প্রতিফলন কতটা ঘটেছে- প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। গণতন্ত্রে নির্বাচনকে উৎসবে রূপ দেয়ার নজির বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু আমরা সে রকমটি দুর্ভাগ্যবশত কী কারণে এখন আর তেমনভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারছি না- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সবাইকে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থ ও প্রয়োজনেই।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, অতীতের পথ ধরেই আমরা অগ্রগর হচ্ছি। বিতর্কিত নির্বাচন করার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারলাম না। ইভিএম নিয়ে যে শঙ্কা ভোটার ও দেশবাসীর মধ্যে আছে তা নির্বাচন কমিশন (ইসি) দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। সিইসি নিজেই বলেছেন ত্রুটি আছে। ইভিএমের দুর্বলতা নিয়ে স্বয়ং সিইসি কে এম নুরুল হুদা নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, গত নির্বাচনে যে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে তাতে ত্রুটি ছিল। কিন্তু কী ত্রুটি ছিল তা বলেননি। এমনকি এই ত্রুটি দূর করে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন তাও তিনি আমাদের জানাননি। তার উচিত ছিল এ ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা দেয়া। আর যারা এই যন্ত্রটি ব্যবহার বা পরিচালনা করবেন সেই প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের ওপরই তো ভোটারদের আস্থা নেই।

বদিউল আলম বলেন, আস্থার সঙ্কটের পাশাপাশি ভোটাররা নিরাপত্তার ঝুঁকিতেও রয়েছেন। ভোটার উপস্থিতি অনেক কম, যা ইসির ব্যর্থতাকেই বোঝায়। ইসি ভোটারদের আগ্রহ বাড়াতে পারেনি। তাদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারেনি ইসি। জাতীয় নির্বাচন থেকে এই আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের হাতে যে ইভিএমে এক শতাংশ ভোট দেয়ার ক্ষমতা রাখা হয়েছে তা যে অপব্যবহার হয়নি এটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সার্বিকভাবে নির্বাচন নিয়ে আস্থার সঙ্কট, ইভিএম নিয়ে একটা ভীতি এবং নিরাপত্তার ঝুঁকিও ছিল এই নির্বাচনে।

মুনিরা খান : নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেমার চেয়ারপারসন মুনিরা খান বলেন, ইভিএম ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া ভালো। তবে এতে নিরাপত্তার ঝুঁকি ও শঙ্কা রয়েছে। একজন ভোটার ব্যালট ইউনিটে ভোট দেয়ার পর তার পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকটি ডিসপ্লে করে ব্যালট ইউনিটের স্ক্রিনে। এটা মুছে যেতে সময় নিচ্ছে। ফলে পরে যে ব্যক্তিটি ভোট দিতে আসবে বা সাথে সাথে যদি কেউ গোপন কক্ষে প্রবশে করে তাহলে সহজেই জানতে পারবে আগের ভোটার কাকে ভোট দিয়েছে। এটা ওই ভোটারের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি। তাই এই ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের উচিত ব্যালট ইউনিটে ডিসপ্লের সময় কমিয়ে আনা। ইভিএমকে আরো আধুনিকায়ন ও দ্রুতগতিসম্পন্ন করা।

তিনি বলেন, নগরপিতা নির্বাচনে ভোটারদের উচিত নিজের অধিকার প্রয়োগ করতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া। কোনো ধরনের অসুবিধা ভোগ করলে সেটা জানালে বাধ্য হয়ে ইসি নির্বাচনকে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করার পদক্ষেপ নিতো। তিনি বলেন, আমাদের ভোটারদের মধ্যে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ভোট প্রদানে একটা অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। তারা ভোট দিতে যেতে চায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে নানান ধরনের মন্তব্যের কারণেই এটার সৃষ্টি হয়েছে। অতীতের সংস্কৃতিও অন্যতম কারণ।

ঢাকার নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলাম অনেক ভোটার হবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ভোটকেন্দ্রে ও বুথে গিয়ে হতাশ হয়েছি। আমার বুথে জানতে চাইলাম ২ ঘণ্টায় কয়টা ভোট পড়েছে, তারা দেখাল ২৭টি। তিনি বলেন, আমরা কেন নির্বাচন কমিশনের হিসাবকে দেখব। নিজেরাই তো হিসাব করে বের করতে পারি কতটা ভোট পড়েছে। আমার হিসাব হলো ঢাকা উত্তরে ২৩ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইসির হিসাব এর চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের জন্য ভোটারদের উচিত নিজের অধিকার প্রয়োগ করা।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com