সাইনাস। খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। আমরা অনেকেই প্রায়ই এই সমস্যায় ভুগি। বিভিন্ন ইনফেকশন, অ্যালার্জি থেকে সাইনাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর ফলে আমরা মাথার যন্ত্রণা, মুখমণ্ডলে যন্ত্রণা, নাক থেকে পানি পড়া এবং নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যায় পড়ি। সাইনাস সাধারণত বায়ুপূর্ণ মিউকাস পর্দায় আবৃত এবং ক্ষুদ্র নালীর মাধ্যমে নাসাগহ্বর তথা শ্বাসনালীর সাথে যুক্ত থাকে। এসব সাইনাস যদি বাতাসের বদলে তরল পদার্থে পূর্ণ থাকে এবং এই তরল যদি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকে সংক্রমিত হয় তখন সাইনাসের মিউকাস পর্দায় প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকের সংক্রমণে বা এলার্জিজনিত কারণে সাইনাসের মিউকাস পর্দায় যে প্রদাহের সৃষ্টি হয় তাকেই সাইনোসাইটিস বলে। সাইনুসাইটিসের কারণে মাথা ব্যথা, মুখমণ্ডলে ব্যথা, নাক দিয়ে ঘন হলদে বা সবুজাভ তরল ঝরে পড়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
সাইনুসাইটিসের প্রকারভেদ : মাথার খুলিতে মুখমণ্ডলীয় অংশে নাসাগহ্বরের দু’পাশে অবস্থিত বায়ুপূর্ণ চারজোড়া বিশেষ গহ্বরকে সাইনাস বা প্যারান্যাসাল সাইনাস বলে। এগুলো হলো : ম্যাক্সিলারি সাইনাস (ম্যাক্সিলারি অঞ্চলে গালে অবস্থিত), ফ্রন্টাল সাইনাস (চোখের ওপরে অবস্থিত), এথময়েড সাইনাস (দু’চোখের মাঝখানে অবস্থিত) এবং স্ফেনয়েড সাইনাস (এথময়েড সাইনাসের পেছনে অবস্থিত)।
স্থায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে সাইনোসাইটিস দু’রকম : অ্যাকিউট সাইনোসাইটিস (স্থায়িত্ব ৪-৮ সপ্তাহ) এবং ক্রনিক সাইনোসাইটিস (স্থায়িত্ব ২ মাসের বেশি সময়)।
রোগের কারণ :
১. ভাইরাস সংক্রমণে: মানুষের শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ নানা ধরনের ভাইরাস ও ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণে এবং কিছু ক্ষেত্রে ছত্রাকে আক্রান্ত হলে সাইনোসাইটিস হতে পারে।
২. ঠাণ্ডাজনিত কারণে ; অ্যালার্জিজনিত কারণে; ব্যবধায়ক পর্দার অস্বাভাবিকতায় সাইনাস গহ্বর অবরুদ্ধ হয়ে; নাকে পলিপ সৃষ্টি হলে; নাসাগহ্বরের মিউকোসা স্ফীতির ফলে নাসাপথ সরু হয়ে ক্রনিক সাইনোসাইটিস হতে পারে।
৩. দাঁতের ইনফেকশন থেকে বা দাঁত তুলতে গিয়েও সাইনাসে সংক্রমণ হতে পারে।
৪. যারা হাঁপানির সমস্যায় ভোগে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিস দেখা যায়।
৫. সাধারণত ঘরের পোকামাকড়, ধুলাবালি, পেস্ট, তেলাপোকা ইত্যাদি যেসব অ্যালার্জেন ধারণ করে তার প্রভাবে এ রোগের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।
৬. ইউস্টেশিয়ান নালীর সামান্য অস্বাভাবিকতায় সাইনাস গহ্বর অবরুদ্ধ হয়ে এবং সংক্রমণের ফলে সাইনোসাইটিস হতে পারে।
৭. নাকের হাড় বাঁকা থাকলে অথবা মুখগহ্বরের টনসিল বড় হলে এ রোগ হতে পারে।
৮. সিস্টিক ফাইব্রোসিসের কারণে এ রোগ হয়।
৯. অপুষ্টি, পরিবেশ দূষণ ও ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের কারণেও এ রোগ হতে পারে।
সাইনাসের লক্ষণ : নাক থেকে হলদে বা সবুজ বর্ণের ঘন তরল বের হয়। এতে পুঁজ বা রক্ত থাকতে পারে। দীর্ঘ ও বিরক্তিকর তীব্র মাথা ব্যথা লেগেই থাকে যা সাইনাসের বিভিন্ন অঞ্চলে হতে পারে। মাথা নাড়াচাড়া করলে, হাঁটলে বা মাথা নিচু করলে ব্যথার তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। জ্বর জ্বর ভাব থাকে, কোনো কিছু ভালো লাগে না বরং অল্পতেই ক্লান্ত লাগে। নাক বন্ধ থাকে, নিঃশ্বাসের সময় নাক দিয়ে বাজে গন্ধ বের হয়। মুখমণ্ডল অনুভূতিহীন মনে হয়। মাথাব্যথার সাথে দাঁত ব্যথাও হতে পারে। কাশি হয়, রাতে কাশির তীব্রতা বাড়ে, গলা ভেঙে যায়।
জটিলতা : সাইনোসাইটিস সংক্রান্ত জটিলতা কেবল নাসিকা গহ্বর ঘিরেই অবস্থান করে না, বরং সাইনাসগুলোর অবস্থান চোখ ও মস্তিষ্কের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গের সংলগ্ন হওয়ায় জীবাণুর সংক্রমণ শুধু সাইনাসেই সীমাবদ্ধ না থেকে রক্তবাহিত হয়ে চোখ ও মস্তিষ্কে পৌঁছলে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কে সংক্রমণের ফলে মাথাব্যথা, দৃষ্টিহীনতা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। চোখে সংক্রমণের ফলে পেরিঅরবিটাল ও অরবিটাল সেলুলাইটিসসহ আরো অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ঘরোয়া পরামর্শ: ঘরোয়া পরামর্শ মিলে চললে মুক্তি মিলবে সাইনোসাইটিস থেকে। সাইনোসাইটিসের সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে প্রচুর পানি পান করুন। এতে শ্লেষ্মা পাতলা হয়ে তা ধীরে ধীরে শরীর থেকে সহজেই বেরিয়ে যায়।
রসুন : রসুনের মধ্যে রয়েছে একাধিক রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। রসুন শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের মতোই কাজ করে। তাই প্রতিদিন অন্তত এক কোয়া রসুন খেতে পারলে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত সমস্যা বা সাইনোসাইটিসের সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া প্রতিদিন ২ কোয়া রসুন ২ চামচ মধুর সাথে মিশিয়ে দিনে দু’বার খেলে সাইনোসাইটিস সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়।
পেঁয়াজের রস: প্রতিদিন এক চামচ পেঁয়াজের রস এক চামচ মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে সাইনোসাইটিসের সমস্যা অনেকটা কমে যাবে। এ ছাড়া, এক চামচ আদা কুচির সাথে এক চামচ মধু খেলে সাইনোসাইটিসের কারণে হওয়া মাথাব্যথা থেকে কিছুটা রেহাই মিলবে।
আর্দ্রতা : কম জলীয়বাষ্পযুক্ত স্থানে সাইনোসাইটিসের সমস্যা বেড়ে যায়। তাই যেখানে বাতাসে জলীয়বাষ্প বা আর্দ্রতার পরিমাণ স্বাভাবিক, তেমন জায়গায় থাকতে চেষ্টা করুন। স্যাঁতসেঁতে বা অতিরিক্ত শুষ্ক আবহাওয়া এড়িয়ে চলুন। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আছে এমন জায়গায় থাকার চেষ্টা করুন।
ধূমপান : সিগারেটের ধোঁয়া, ধুলাবালি, হেয়ার স্প্রে, বডি স্প্রে ইত্যাদি জিনিসগুলো থেকে দূরে থাকুন। এ ধরনের জিনিসগুলো নাসিকা পথে ঢুকে যায় এবং সাইনোসাইটিস সমস্যা বাড়ায়। রাস্তায় বের হলে নাকে কাপড় দিয়ে রাখুন বা মাস্ক পরে নিন।
ভেজা তোয়ালে : সাইনোসাইটিসের কারণে নাকে, মাথায় বা কপালে অস্বস্তি হলে গরম পানিতে একটি তোয়ালে ভিজিয়ে ভালো করে নিংড়ে নিন। এর পর তোয়ালেটা মুখের ওপর দিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন। এই পদ্ধতিতে সাময়িকভাবে অনেকটা আরাম পাওয়া যায়।
গরম পানির ভাপ : সাইনোসাইটিস সমস্যায় গরম পানির ভাপ নিতে পারলে দ্রুত উপকার মেলে। এটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। গরম জলের ভাপ নিলে আমাদের নাসিকা-পথ ভেজা থাকবে এবং সহজেই শ্লেষ্মা বেরিয়ে আসবে। তাই গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে দিনে ২ বার করে ভাপ নিন।
দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিস নিম্নলিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যেতে পারে :
শারীরিক পরীক্ষা : ডাক্তার রোগীকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করবেন, রোগীর উপসর্গ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, মুখ বা নাকের কোমলতা পরীক্ষা করবেন এবং নাকের ভিতর দেখবেন। ডাক্তার রোগীর অতীত এবং বর্তমান চিকিৎসা অবস্থা সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করেন।
ইমেজিং পরীক্ষা : সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই স্ক্যানের মতো পরীক্ষাগুলো অনুনাসিক এবং সাইনাস এলাকার বিশদ বিবরণ দেখায়। এটি টিউমার, ছত্রাক বা পলিপের মতো প্রদাহ বা শারীরিক অবরোধ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে, যা এন্ডোস্কোপ ব্যবহার করে শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে।
এন্ডোস্কোপি : ডাক্তারকে সাইনাসের ভিতরে দেখতে দেয়ার জন্য নাকের মধ্য দিয়ে ফাইবার-অপ্টিক আলোসহ একটি দীর্ঘ, পাতলা, নমনীয় টিউব ঢোকানো হয়। এটি একটি বিচ্যুত অনুনাসিক সেপ্টাম, টিউমার বা পলিপ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে।
অ্যালার্জি পরীক্ষা : অ্যালার্জি দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিস হতে পারে বলে মনে করা হলে একটি অ্যালার্জি ত্বক পরীক্ষার সুপারিশ করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাটি কী অ্যালার্জেনগুলো অনুনাসিক ফ্লেয়ার-আপ সৃষ্টি করছে তা শনাক্ত করতে সহায়তা করে।
সংস্কৃতি : ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের মতো দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিসের কারণ নির্ধারণের জন্য অনুনাসিক এবং সাইনাস স্রাব থেকে নমুনা নেয়া হয়।
হোমিও সমাধান : একজন অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকে রোগীর পুরা লক্ষণ নির্বাচন করতে পারলে তাহলে হোমিওপ্যাথিতে সাইনাসের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। যেহেতু হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা লক্ষণভিত্তিক সেহেতু লক্ষণের ভিত্তিতে চিকিৎসা করা বাঞ্চনীয়। লক্ষণের ওপর যেই সব ওষুধ আসতে পারে, নাক্স ভমিকা, টিউবার কুলার, লেমনা মাইনর, ক্যালকেরিয়া কার্ব, সোরিনাম, থুজাসহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের ওপর আসতে পারে। তাই ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
লেখক : চিকিৎসক, কলামিস্ট