শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৬ অপরাহ্ন

চীন-জাপান সঙ্ঘাত ও ঢাকার জন্য বার্তা

মাসুম খলিলী
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২৩
  • ১২৩ বার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে সঙ্ঘাতময়। ইউক্রেন যুদ্ধ ও তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা সঙ্ঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে এশিয়াকে। নতুন মেরুকরণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র পক্ষের প্রধান শক্তি রাশিয়া যুক্ত হয়েছে চীনের সাথে। অন্য দিকে বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম শক্তি জাপান আত্মরক্ষামূলক সামরিক কৌশলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আক্রমণাত্মক পর্বে প্রবেশ করছে। প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি করে জি-৭ ও ন্যাটোর পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে এশিয়ায় চীনবিরোধী বলয়ে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে টোকিও। এশিয়ার এই দুই শক্তির সাথে বাংলাদেশের রয়েছে নির্ভরতার গভীর সম্পর্ক। চীন-জাপানের আসন্ন এই সঙ্ঘাতের কি প্রভাব পড়তে পারে ঢাকার ওপর আর জাতীয় স্বার্থে যদি এক পক্ষকে বেছে নিই তাহলে বাংলাদেশ কোন বলয়ে যেতে পারে এ নিয়ে আজকের আলোচনা।

খোলসমুক্ত জাপান ও তার মিত্ররা
আত্মরক্ষামূলক নীতি থেকে বেরিয়ে আসার কাজ শুরু হয়েছিল আততায়ীর হাতে নিহত সাবেক জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজু আবের সময়। তার উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এটি জোরদার করেছেন। জি-৭ দেশগুলো সফরের শেষ পর্যায়ে কিশিদা যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দেখা করেছেন। কিশিদার যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে, দুই দেশ নিরাপত্তা পরামর্শক কমিটির একটি ‘২+২’ বৈঠক করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমন্বয় করে জাপানের কাউন্টারস্ট্রাইক ক্ষমতার কার্যকর সংস্থানের ব্যাপারে সহযোগিতা আরো গভীর করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে কিশিদার সফরে মূলত নিরাপত্তা সহযোগিতা উন্নয়নের বিষয়ে মনোনিবেশ করা হয়েছে। এই পাঁচটি দেশ কেবল জি-৭ দেশ নয়, তারা ন্যাটোর সদস্যও। এতে স্পষ্ট যে জাপান তার নিরাপত্তা উদ্বেগ থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক বিষয়গুলোতে ন্যাটোর সাথে নিরাপত্তা সম্পৃক্ততার সমন্বয় বাড়াতে চাইছে।

জাপানের মন্ত্রিসভা গত মাসে তিনটি মূল প্রতিরক্ষা নথি পাস করেছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং ‘কাউন্টারস্ট্রাইক’ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সঙ্কল্প। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সবচেয়ে বড় সামরিক সংস্কার। আর কিশিদার সিরিজ সফর ‘বিদেশী সমর্থন’ খোঁজার চেষ্টা বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটাও ধারণা করা হচ্ছে যে, কিশিদার মার্কিন সফর তিনটি ‘উপহার’ নিয়ে আসবে, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য জাপান-মার্কিন জোটকে গভীরতর করার চেষ্টা করা হতে পারে; জাপানের আত্মরক্ষামূলক প্রতিরক্ষা নীতি ভেঙে ফেলার জন্য ওয়াশিংটনের সমর্থনের বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উন্নয়ন ও চীন-বিরোধী নীতি গ্রহণ করা হতে পারে; আর চীনা হুমকি সামনে রেখে জাপান তার নিজস্ব সামরিক সম্প্রসারণ করতে পারে।

জাপান গত মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তার বৃহত্তম সামরিক বিল্ড আপের কথা ঘোষণা করে। এটি সাত দশকের শান্তিবাদ থেকে জাপানের একটি নাটকীয় প্রস্থান, যা মূলত চীনা কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট উদ্বেগ দিয়ে প্রভাবিত। জাপান গত মাসে প্রতিরক্ষা ব্যয় পাঁচ বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের ২%-এ উন্নীত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যা ঐতিহাসিকভাবে জিডিপির ১ শতাংশের নিচে ছিল। জাপানি নেতারা দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যয় এবং সমন্বয় বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করেন মূলত চীন বলপ্রয়োগে তাইওয়ান দখল করে নিতে পারে এবং উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার স্পাইক বিচ্ছিন্ন দেশটির পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা অর্জনের সূচনা করতে পারে মর্মে উদ্বেগ বৃদ্ধির সাথে সাথে।

গত সপ্তাহে কিশিদা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে একটি ইউরোপীয় দেশের সাথে জাপানের প্রথম চুক্তি করেন, যাতে দুই দেশের যৌথ সামরিক মহড়া করার কথা বলা হয়েছে। কিশিদা কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা উন্নয়নের বিষয়েও আলোচনা করেছেন। জার্মানি ছিল একমাত্র জি-৭ দেশ যেখানে কিশিদা যাননি।
প্রতিরক্ষা নিয়ে জাপানের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো লক্ষ করার মতো। গত মাসে মার্কিন তৈরি টমা হক এবং অন্যান্য দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার পরিকল্পনা ঘোষণা করে দেশটি যা চীন বা উত্তর কোরিয়ায় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর নেয়া জাপানের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। জাপান মস্কোর ওপর আক্রমণাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের সাথে যোগ দিতে একটুও বিলম্ব করেনি। জাপানি গাড়ি নির্মাতা মাজদা, টয়োটা এবং নিসান রাশিয়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।

বৈঠকের পর জারি করা মার্কিন-জাপান যৌথ বিবৃতি অনুসারে, বাইডেন তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা মৌলিকভাবে শক্তিশালীকরণ এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য জাপানের সাহসী নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। কিশিদা বলেছেন যে, তিনি রফতানি নিষেধাজ্ঞাসহ উন্নত সেমিকন্ডাক্টরগুলোতে চীনের অ্যাক্সেস সীমিত করার বাইডেনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন। এর আগে অক্টোবরে তিনি ওয়াশিংটন আরোপিত চিপ-উৎপাদন সরঞ্জামের রফতানির ওপর সুইপিং সীমাবদ্ধতা মেলাতে রাজি হননি।

চীনের উৎকণ্ঠা
জাপানের আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ এবং এ ব্যাপারে ন্যাটোর সাথে সমন্বিত ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগে চীনে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। চীন সরকারের কৌশলগত মুখপত্র হিসাবে খ্যাত গ্লোবাল টাইমস এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেছে, “জাপানের কৌশলগত প্ররোচনা এবং চীনের প্রতি ওয়াশিংটনের স্বার্থপর কৌশল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য অপরিমেয় ঝুঁকি তৈরি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান বলে চলেছে যে তারা ‘নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা’ বজায় রাখতে চায়, কিন্তু তারা আসলে এর ভিত্তি নাড়িয়ে দিচ্ছে।”

বেইজিংয়ের বড় উদ্বেগের কারণ হলো, ওয়াশিংটনের চীন কৌশলের সাথে সহযোগিতা ও সমন্বয় করে জাপান তার নিরাপত্তা কৌশল সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে। চীনা নীতিপ্রণেতাদের ধারণা জাপান ‘একচেটিয়া প্রতিরক্ষা’ নীতি পরিত্যাগ এবং তার শান্তি সংবিধানের বিধিনিষেধ থেকে দূরে সরে যেতে চায়। দেশটির কৌশলবিদরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে জাপান যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করতে চায়।

চীনের উদ্বেগের আরো কারণ হলো, কিছু মার্কিন মিডিয়া জাপানকে ‘শক্তিশালী হতে’ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। বেইজিং এর মধ্যে যে চীনা উচ্চাকাক্সক্ষার পথে জাপানকে বাধা হিসাবে দেখছে তাতে সংশয় নেই। তারা চায় জাপান তার শুধু যুদ্ধোত্তর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুক এবং কেবলই নিজের প্রতি গুরুত্ব দিক। তার ভূখণ্ডের উপর উত্তর কোরিয়ার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে গেলেও কেবল তা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকুক। কোনোভাবেই প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও ব্যয় বৃদ্ধি না করুক টোকিও।

বাস্তবে এটি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ চীন বলছে, বিগত ৭০ বছরে, জাপান কখনোই তার পরাজয় পুরোপুরি মেনে নেয়নি, যা তার জট পাকানোর মূলে পরিণত হয়েছে। টোকিওর জন্য এটি উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেকে ‘বর্শা’ বা ‘ঢাল’ না বানিয়ে শান্তি ও উন্নয়নের সাধারণ আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে দেশটির সহায়তা করা দরকার।

জাপান-চীন সঙ্ঘাতে ঢাকায় প্রভাব
জাপান ও চীন দুটি দেশই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী ও বাণিজ্যিক অংশীদার। এই দুই দেশের সম্পর্কের যে অবনতিশীল প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়তে পারে।

জাপান ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। তার পর থেকে, দুই দেশ উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যাকে উন্নয়ন অংশীদারিত্বের একটি ‘ভালো মডেল’ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।

জাপান ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশকে সরকারি উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে উদারভাবে অনুদান দিয়েছে এবং বাংলাদেশের একক বৃহত্তম দাতা হয়ে উঠেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সাথে একটি সমন্বিত অংশীদারিত্ব শুরু করার পর জাপান থেকে আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে, জাপান বাংলাদেশকে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি ২.৬৩ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে, জাপান মোট ২৪.৭২ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করেছে। এই সহায়তার অর্ধেক অনুদান এবং বাকিটা ঋণ। বাংলাদেশে জাপানের উন্নয়ন সহায়তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে শুরু করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যন্ত বাস্তব ও অস্পষ্ট অবকাঠামো উন্নয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রকে কভার করে।

এশিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি গন্তব্য জাপান। গত এক দশকে জাপানে বাংলাদেশের রফতানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ প্রধানত তৈরি পোশাক এবং চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে। জাপান থেকে বাংলাদেশের প্রধান আমদানির মধ্যে রয়েছে লোহা ও ইস্পাত, যানবাহন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাপানে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ১.৩ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ছিল ১.৮ বিলিয়ন ডলারের।

ভারত মহাসাগরকে জাপানের জন্য একটি লাইফলাইন হিসাবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এর প্রায় ৮০ শতাংশ সামুদ্রিক বাণিজ্য এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যায়। ভারত মহাসাগরে যেকোনো ঝামেলা জাপানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে। বিশ্ব মঞ্চে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে বাংলাদেশ জাপানের কৌশলগত ক্যালকুলাসে গুরুত্বপূর্ণ শুধু দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে তার অনন্য অবস্থানের কারণে নয় বরং ভারত মহাসাগরে প্রবেশের জন্যও দেশটি গুরুত্বপূর্ণ। অন্য দিকে, জাপানের সাথে সুদৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশকে তার ‘প্রাচ্যের দিকে তাকান’ নীতি সফলভাবে বাস্তবায়নে সহায়তা করবে বলে মনে করা হয়।

জাপানের বে অফ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিআইজি-বি) দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি গেটওয়ে তৈরি করে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে এই উদ্যোগ। বাংলাদেশে বিআইজি-বি-এর অধীনে বাস্তবায়িত প্রধান প্রকল্পগুলো হচ্ছে ঢাকায় এমআরটি লাইন, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা বিমানবন্দরের তিন টার্মিনাল এবং আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল। একবার বাস্তবায়িত হলে, এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ল্যান্ডস্কেপকে নতুন আকার দেবে, শিল্প সমষ্টি বৃদ্ধি করবে, শক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং আঞ্চলিক সংযোগ বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ায়, জাপানের কৌশলগত-কূটনৈতিক এজেন্ডায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে মুক্ত-বাজার, বাণিজ্যমুখী অর্থনীতির একটি এবং ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় লাভজনক বাজার হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত, উচ্চ ক্রয়ক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা, সস্তা শ্রম এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্রুত গতিসহ ১৬৪ মিলিয়ন গ্রাহকের একটি বাজার জাপানকে বাংলাদেশকে তার ভূকৌশলগত কক্ষপথে রাখতে সাহায্য করবে।

অর্থনৈতিক সুবিধা ছাড়াও, ঢাকার সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক টোকিওকে তার ক্ষমতার সমীকরণ নতুন করে তৈরি করতে সাহায্য করবে। অন্য দিকে, জাপানের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ বাংলাদেশকে তার পূর্ণ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে, স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে স্নাতক হওয়ার পর উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে, ২০২৬ সালে কার্যকর হতে এবং বৃহৎ শক্তির সাথে এর কূটনৈতিক সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনতে সহায়তা করবে।

জাপানের সাথে বাংলাদেশের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিপরীতে চীন-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বও গভীরতর হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর চীন ও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে, বিগত বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শক্তিশালী এবং স্থিতিশীলভাবে বিকাশ লাভ করছে। দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফরের ধারাবাহিকতায়, অক্টোবর ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর উল্লেখযোগ্য।

২০১৬ সাল থেকে, চীন সরকার বাংলাদেশকে প্রদত্ত রেয়াতি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। বাংলাদেশে পরিবহন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে চীনা উদ্যোগের দ্বারা বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক অবদান রাখছে।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বর্তমানে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর অধীনে সবচেয়ে বড় জি-টু-জি প্রকল্প, যার ব্যয় ৩.১ বিলিয়ন ডলার। কর্ণফুলী নদী প্রকল্পের অধীনে মাল্টিলেন রোড টানেল দক্ষিণ এশিয়ার নদীর তলদেশের একমাত্র টানেল, যেটি চীন সরকারের কাছ থেকে রেয়াতি ঋণ দ্বারা অর্থায়ন করা হয়। এ ছাড়া পদ্মা সেতু ও কক্সবাজার রেলওয়ের মতো প্রকল্প চীনা কোম্পানিগুলো হাতে নিয়েছে। সম্পন্ন হলে, এই প্রকল্পগুলো স্থানীয় জনগণের ভ্রমণ ব্যাপকভাবে সহজ করবে এবং আঞ্চলিক সংযোগ বাড়াবে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে, চীনা সহায়তাপুষ্ট গুলাশাও ৩৬৫ মেগাওয়াট, পায়রা ১,৩২০ মেগাওয়াট, এস আলম ১,৩২০ মেগাওয়াট, পটুয়াখালী ১,৩২০ মেগাওয়াট এবং বরিশাল ৩৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টের মতো কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্পের সমাপ্তির সাথে সাথে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সঙ্কট নিরসন হবে এতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ এবং ২০১৯ সালের শেষে বাংলাদেশে চীনের এফডিআই ছিল যথাক্রমে ৭০ মিলিয়ন ডলার এবং ৮৩৩ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮ থেকে টানা তিন অর্থবছরে, চীন থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের নিট প্রবাহ বাংলাদেশে এফডিআই উৎসের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। বিগত ৪৫ বছরে, চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্য সহযোগিতায় যথেষ্ট অগ্রগতি করেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবার বছরে দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩.০৬ মিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে বাণিজ্যের পরিমাণ ১৮.৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। এর মাধ্যমে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ যে পণ্য চীন থেকে আমদানি করে তার তুলনায় রফতানি করে ৫ শতাংশের মতো।

গন্তব্য কোন পক্ষে
বৈশ্বিক পরিসরে চীন জাপান যে কৌশলগত সঙ্ঘাত চলছে তাতে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ অভিন্ন পক্ষ। অন্য দিকে চীনের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে রাশিয়ার। দুই পক্ষ যেভাবে বলয় তৈরির বেপরোয়া প্রয়াস চালাচ্ছে তাতে দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনও একই কথা বলেছেন। যদি কোনো এক পক্ষকে বেছে নিতে হয় সেটি কোন পক্ষ হবে এটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা রিয়ার এডমিরাল আইলিনের চার দিন সফর শেষে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র ঢাকা সফর এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে রফতানি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বহুপক্ষীয় বিনিয়োগ ও প্রবাস কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বৈশ্বিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে প্রভাবের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। সেই বিবেচনায় ঢাকার কৌশলবিদরা ভেনিজুয়েলা ধরনের বিচ্ছিন্নতার নীতি বিপর্যয়কর হতে পারে বলে মনে করেন। পাশ্চাত্যের বৈরিতা বরণ করে চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করলে এটি হতে পারে। এ বিবেচনায় চীন জাপান সঙ্ঘাতে চীনের সাথে যতটা সম্ভব সম্পর্ক বজায় রেখে জাপান ও পাশ্চাত্য বলয়ে থাকার বিষয় ঢাকাকে বিবেচনা করতে হবে বলে ঢাকার কৌশলবিদরা মনে করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com