গণফোরামের সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সরকার পরিবর্তনে আর সভা-সমাবেশ নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নামতে হবে।
খালেদা জিয়ার কারাভোগের দুই বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে শনিবার দুপুরে এক আলোচনা সভায় তিনি এই আহবান জানিয়ে বলেন, ‘এখন আমি মনে করি যে, এই ধরনের সভা নয়। এখন আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে সামনে রেখে মাঠে নামবো এবং এটা অর্জনে জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে আমরা চলুন সবাই ভূমিকা রাখি। যারা ক্ষমতা আত্মসাৎ করেছে তাদের চিহ্নিত করে বিতাড়িত করি। আসুন আর এক মিনিটও দেরি না করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের ক্ষমতা আমরা উদ্ধার করি। শহর-জেলায় আমাদেরকে যেতে হবে, বলতে হবে- রুখে দাঁড়ান। দেশটা আমাদের সকলেরই, দেশের ক্ষমতা যারা আত্মসাৎ করেছে তাদের হাত থেকে আমরা দেশকে মুক্ত করি।’
ড. কামাল বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠন করতে হবে, সেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যাদের হবে তারা সরকার পরিচালনা করবে। এদের (ক্ষমতাসীনদের) বলে তো কোনো লাভ নেই, এদের লাথি মেরে বের করে দেয়া দরকার। পদত্যাগ পদত্যাগ না বলে ….।’
পদত্যাগ না করলে কী করতে হবে প্রশ্ন করলে সভায় উপস্থিত কর্মী-সমর্থকরা বলেন, ‘লাথি মেরে বের করতে হবে’।
তখন ড. কামাল বলেন, ‘গুড। ওইসব ভাষা না বলে তাদেরকে অন্তত হাত ধরে টেনে রাস্তায় নামিয়ে দিতে হবে আর কী।’
কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তির জন্য এখানে সভা করতে হবে, দাবি করতে হবে-এটা অকল্পনীয়। ৪৮ বছর দেশ স্বাধীন হয়েছে এখনো রাজবন্দির মুক্তির কথা বলতে হবে-এটা দুঃখের বিষয়। আসুন এখন আর সভা নয়, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামি।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা সবসময় দেখেছি বাংলাদেশের জনগণকে বঞ্চিত করে এখানে স্বৈরতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কেউ দিতে পারেনি। চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে। আজকে যারা স্বৈরাচার চালিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে সেই ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখা দরকার বাঙালি জাতি কোনো সময়ে স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নেবে না, মেনে নেয়নি। আমরা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে চাই দেশটাকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক। জনগণ দেশের মালিক, মালিক হিসেবে তাদের যেন শ্রদ্ধা করা হয়, মালিক হিসেবে তারা যেন ভূমিকা রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা যাতে থাকে।’
প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘এখানে যারা কথা বলেছেন, সবাই একমত দেশ জনগণের মালিকানায় ফিরে আসতে হবে। ৪৮ বছর হয়ে গেছে-এখন স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে যাচ্ছে। এই সময়ে লজ্জার ব্যাপার হবে দেশের জনগণ ক্ষমতাচ্যুত থাকে, যেখানে সরকার জোর করে ক্ষমতা দখল করে মানুষকে বঞ্চিত করে যাচ্ছে- এটা আমরা মেনে নেই। এটা মেনে নেয়া যায় না। তারা কী সব প্রচার করছে যে, অমুক বছর এভাবে তারা উদযাপন করবে। একভাবে উদযাপন করতে হবে। মালিককে মালিকানা হিসেবে আমাদের ১৬ কোটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে বঞ্চিত করে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবে-এটা একটা প্রহসন। অর্থাৎ যারা প্রহসন করে এসেছে তাদের এখন সময় এসেছে সহজ ভাষায় বলা, সরে দাঁড়াও, সরে দাঁড়াও, সরে দাঁড়ান।’
ড. কামাল অভিযোগ করে বলেন, ‘তোমরা যেভাবে ক্ষমতা আত্মসাত করে জনগণকে বঞ্চিত করে স্বৈরতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছো এবং যেভাবে দুর্নীতি, যেভাবে কুশাসন, যেভাবে মানুষের বিরুদ্ধে অত্যাচার চলছে, যেভাবে লক্ষ লক্ষ মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে –এটা মানুষ আর মেনে নেবে না। কথা হলো যে, তোমরা সরে দাঁড়াও। না হলে স্বাধীনতার প্রতি, মানুষের প্রতি অসম্মান জানানো হচ্ছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য জীবন দিয়েছিলো তাদের প্রতি অসম্মান জানানো হচ্ছে। তোমাদের যারা ক্ষমতা জবর-দখল করে রেখেছো সেখান থেকে সরে আসতে হবে।’
আজ শনিবার দুপুরে সেগুন বাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) কার্যালয়ে সাবেক তিন বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ২ বছরের কারাবাসের প্রতিবাদে এই সভা হয়।
ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে ও জাহাঙ্গীর আলম প্রধানের সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সভায় বিএনপির ড. আবদুল মঈন খান, জেএসডির আ স ম আব্দুর রব, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্যের ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, মহসিন রশিদ, জগলুল হায়দার আফ্রিক, মোশতাক হোসেন, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, মমিনুল ইসলাম, জেএসডির শাহ আকম আনিসুর রহমান খান, বিকল্পধারার অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, শাহ আহমেদ বাদল, গণ দলের গোলাম মাওলা চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, আমি সরকারকে প্রধানকে বলবো, আপনি শান্তিপূর্ণভাবে যেতে চান, না অন্যভাবে যেতে চান। যদি শান্তিপূর্ণভাবে যেতে চান তাহলে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন। আর যদি শান্তিপূর্ণভাবে না যেতে চান তাহলে দুই সিটি করপোরেশনে জনগণ ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে যেভাবে অনাস্থা দিয়েছে সেজন্য অপেক্ষা করুন। আমি বিএনপি করি না, আমি দলীয় স্বার্থে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রয়োজন।
দেশের চিত্র তুলে ধরে নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি ধসে পড়েছে, সরকারের কাছে টাকা নাই। এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বলা হয়েছে যাদের কাছে উদ্বৃত্ত অর্থ আছে তাদেরকে সেটা রাজকোষে জমা দিতে হবে। এরপরেও কী বলবার দরকার আছে যে, আমাদের রাজকোষে টাকা নেই, সরকারের কাছে টাকা নেই। চোরগুলো সমস্ত টাকা চুরি করে লুট করে এখন দেশকে ফোকলা বানিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপার একটাই, ওই পুতু পুতু করে কাজ হবে না। বলেন, স্পষ্ট করে বলেন, এই সরকারকে আমরা চাই না একদিনের জন্য চাই না। তারজন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে চাই। আমি মনে করি, ঐক্যফ্রন্ট নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার। বিএনপির কাছে একই প্রশ্ন আমাদের, আপনাদেরও সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার যদি সত্যি সত্যি এই স্বৈরাচার, দুরাচার, অপশাসন, দুঃশাসন থেকে মুক্তি চান তাহলে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামতে হবে।’
খালেদা জিয়াকে ‘অন্যায়ভাবে’ আটক করে রাখার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত না খালেদা জিয়াকে সরকার মুক্তি না দেবে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি এক ব্যক্তি কিছুটা হলেও তাকে (খালেদা জিয়া) প্রভাবিত করেছিলাম প্রথমবারে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য। আজকে আমি বুঝতে পারছি যেভাবে সরকার এই নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে তাতে অংশ নেয়া ঠিক হবে না। খালেদা জিয়ার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন অংশগ্রহন অর্থহীন।’
‘খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয় আমার আরো দুইটা সুপারিশ আছে। একটা হলো আমাদের নেতা ড. কামাল হোসেন সাহেব তার (খালেদা জিয়া) জন্য রিভিউ পিটিশন করুন। সরকারের মান রক্ষার জন্য না, সরকারকে সম্মানজনক এক্সিট দেয়ার জন্য উনি রিভিউ পিটিশন করুক তার প্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি দেয়া হোক। সরকারকে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে বসে অপচয় বন্ধ করতে হবে। এই নির্বাচনের নামে যে টাকার অপচয় হচ্ছে তা বন্ধ করতে এই কমিশন বদলিয়ে কমিশনে এমন কর্মকর্তাকে দিতে হবে যার কোমড়ের জোর আছে, মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে।’
আন্দোলনে জনগণকে সংগঠিত করতে ড. কামাল হোসেনকে পদযাত্রা শুরু করার পরামর্শ দেন তিনি।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যেতে হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে।