সমাজের সম্মানিত মানুষদের মধ্যে শিক্ষকরা অন্যতম। কেননা শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ড দণ্ডায়মান রাখার কাজটি শিক্ষকরাই করে থাকেন। তাঁরা আমাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। আমাদের জীবন আলোকিত করেন। তাঁদের একেক ফোঁটা ঘাম আমাদের চলার পথের আলোকবর্তিকার জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। তাঁরা নিজেকে জ্বালিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেন। ইসলাম তাঁদের বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। এবং তাঁকে সম্মান করো, যাঁর থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো।’ (আল-মুজামুল আউসাত, হাদিস : ৬১৮৪)
শিক্ষকতার পেশা সম্মানিত হওয়ার আরেকটি কারণ রাসুল (সা.) নিজেই ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৯)।
আবার সমাজ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিলে, তা নিশ্চয়ই সমাজে বিপর্যয় ডেকে আনে। বিস্কুট বানানোর ছাঁচে ত্রুটি থাকলে যেমন তা দিয়ে তৈরি করা বিস্কুটগুলো ত্রুটিযুক্ত হবে। তেমন কোনো শিক্ষক নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে ফেললে তার প্রভাব তার ছাত্রদের মধ্যে পড়বে। তাদের মধ্যেও অনৈতিকতার চর্চা হবে স্বাভাবিক বিষয়।
ইদানীং কিছু শিক্ষকের ব্যাপারে উত্থাপিত অভিযোগ জাতিকে হতাশ করছে। অভিযোগ উঠছে মানুষ গড়ার কারখানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও। গণমাধ্যমে প্রকাশ দেশের বহু প্রতিষ্ঠান কারিকুলামের বাইরে থাকা নোট ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করছে। কোন নোট ও গাইড বই কিনতে হবে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের তা পড়তে বাধ্য করার অভিযোগ এখন অহরহ। কেউ কেউ দাবি করছে, শিক্ষকরা নির্দিষ্ট গাইড থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন করেন। ফলে তাদের পছন্দের গাইড-নোট না কিনলে পরীক্ষায় ভালো করা অসম্ভব। কিছু শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে তাঁদের সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এর প্রভাব পরীক্ষার ফলাফলের ওপরও পড়ে। সমাজে এ ধরনের দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম হলেও শরীরের ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার জন্য একটি বিষফোঁড়াই যথেষ্ট। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এর মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম মো. ফারুক নোট ও অতিরিক্ত বই যাতে না কেনে এবং শিক্ষার্থীদের তা না পড়ানোর জন্য নির্দেশনা জারি করেন। গত (২১ জানুয়ারি ২০২০) অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আদেশে বলা হয়, দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজের বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি, সেশন ফি, ফরম পূরণে সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে। স্কুল ও কলেজ বিভিন্ন খাতে এ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। (বাংলা ট্রিবিউন)
এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, কোনো কোনো গাইড ও নোট বই মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান অনৈতিকভাবে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আর্থিকভাবে প্রলুব্ধ করে। তারা এসব নোট ও গাইড শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করে। এই নোট ও গাইড বন্ধে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। (প্রথম আলো)
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, গাইড ও নোট বই মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষকদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে তাদের ব্যবসা চাঙ্গা করার জন্য শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে ফেলেছে। কোনো কম্পানি থেকে এভাবে উপকার ভোগ করা শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ নেই। এটি ঘুষের নামান্তর। আবদুল্লাহ ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতাকে অভিশাপ করেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫৮০)
শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকরা যুক্তিযুক্ত যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু তাতে একটি দক্ষ জাতি গড়ে তোলাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। যদি সেখানে ব্যবসা মুখ্য হয়, তাহলে জাতি আরো পিছিয়ে পড়বে। এই শিক্ষার্থীরা একসময় বড় দুর্নীতিবাজ হবে। ঘুষখোর হবে। কেননা তাকে এই অবস্থানে আসতে তাদের শিক্ষাজীবন থেকেই ঘুষ দিতে হয়েছে। আবার শিক্ষকদের যদি তাদের চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন অফিশিয়াল কাজে ঘুষ দিতে হয়, তাহলে তাদের মধ্যেও যেকোনো উপায়ে টাকা উপার্জনের চিন্তা আসা স্বাভাবিক। সবার উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বচ্ছ ও সৎ হওয়া। অন্যায়ভাবে মানুষের অর্থ নিজের পকেটে আনার রীতি থেকে বেরিয়ে আসা।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু। (সুরা নিসা, আয়াত : ২৯)
আমরা সবাই যদি কোরআনের বাণীগুলো মেনে চলতে পারি। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের সমাজ থেকে সব ধরনের দুর্নীতি উঠে যাবে। শিক্ষাঙ্গনসহ সব সেক্টরে শান্তি, শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আমাদের দেশের বড় বড় কলকারখানা চালানোর জন্য বিদেশি কর্মী আনতে হবে না।