আমাদের দেশে অপরিকল্পিত ভর্তি পরীক্ষার কারণে অযথা শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও মানসিক চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তা ছাড়া কোচিং-বাণিজ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নোট-গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্যে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত শিক্ষার সুফল আমরা পাচ্ছি না।
শিক্ষাই যেখানে জাতির মেরুদণ্ড, সেখানে অপরিকল্পিত, দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলার আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়েন। মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে পরিকল্পিত নিয়ম না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী সব ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
অনেক সময় একই দিনে বা পরের দিন কয়েক জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এমন অবস্থায় বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দৌড়াদৌড়ি করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
ভর্তি পরীক্ষায় বর্তমান নিয়ম অবশ্যই পরিবর্তন এনে শিক্ষার্থীদের অযথা হয়রানি ও মানসিক চাপ থেকে বাঁচাতে হবে। এ হয়রানি বন্ধে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই জয়েন্ট ইনট্রান্স পরীক্ষা নামে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে মেধা তালিকা করে ভর্তি নিশ্চিত করা হয়। এই পদ্ধতি আমাদের দেশে অনুসরণ করা যেতে পারে বা আমাদের দেশে বর্তমান মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার মতো পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। একই নিয়মে কৃষি বিষয়ে সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। এই ভর্তি পরীক্ষাগুলো বিরতিহীনভাবে প্রতিদিন একটি করে পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থীরা স্থান ত্যাগ, ছোটাছুটি, যাতায়াত ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবেন। এই ভর্তি পরীক্ষা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে নিতে পারলে ভর্তি কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ হতে পারে। অথবা আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দৌড়াদৌড়ি, হয়রানি ছাড়া মেধা যাচাইয়ে সঠিক পথে বের করে মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভর্তিপরীক্ষার ফল প্রকাশের পর মূল পরীক্ষা অর্থাৎ এসএসসি ও এইচএসসি ফল প্রকাশ হলে উভয় পরীক্ষার নম্বর যোগ করে মেধা অনুযায়ী ভর্তির ফলও প্রকাশ করা যেতে পারে।
ভর্তি পরীক্ষায় এসব বিকল্প বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষাব্যবস্থায় দল-মত নির্বিশেষে সঠিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবীরা উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবেন বলে আমাদের ধারণা। এ জন্য সৎ, যোগ্য মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। তাদের দ্বারা পাঠদানে শিক্ষার্থীরা ফের ক্লাসমুখী। শিক্ষা কারিকুলাম বিচার-বিশ্লেষণ করে সব বিষয়ে কর্মমুখী শিক্ষা চালু করাই হচ্ছে এখন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। অতিরিক্ত বইয়ের চাপ কমিয়ে খেলাধুলার মাধ্যমে পড়াশোনা আনন্দময় করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। যেকোনো মূল্যে প্রশ্নফাঁসকারীদের দল-মত নির্বিশেষে কঠিন হাতে দমন করতে হবে। দমনে ব্যর্থ হলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হবে। অন্য দিকে অদক্ষ, অযোগ্য মেধাশূন্য শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে সঠিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যর্থ হবে। এটি অব্যাহত থাকলে জাতি মেধাশূন্য হয়ে দেশ অনেক পিছিয়ে যাবে। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতি রুখতে হবে।
ভর্তি পরীক্ষার অযথা হয়রানি নিরসনে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্তে ভিসিদের বৈঠক হয়েছে।
গত ২৫ জানুয়ারি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. কাজী শহিদুল্লাহ জোর দিয়ে বলেছেন, ‘লাখ লাখ শিক্ষার্থীর অযথা হয়রানি, অর্থব্যয়, সময় অপচয় ও ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’
লেখক : সাংবাদিক