বাংলাদেশ সরকার চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাস বাকি থাকতেই ব্যাংক থেকে টার্গেটের তুলনায় অনেকে বেশি ঋণ নেয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাবের আশংকা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সাত মাসেই সরকার টার্গেটের চেয়ে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় অর্থসংকট কাটাতে এবছর ব্যাংকের উপর সরকারের নির্ভরশীলতা আরও বাড়তে পারে।
কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থবছরের বাকি কয়েকমাসে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমানোর চেষ্টা তাদের রয়েছে। চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাত মাসেই সেই টার্গেট ছাড়িয়ে সরকার প্রায় সাড়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকে পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, সরকার অর্থসংকটের কারণে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
কিন্তু কেন এই অর্থসংকট?
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলছিলেন, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায় অনেক কম হওয়ার কারণেই সরকারকে এবার বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে।
‘রাজস্ব আহরণ টার্গেটের থেকে প্রথম ছয়মাসে অনেক কম হয়েছে। এরফলে অর্থের জন্য সরকারকে অন্য সূত্র খুঁজতে হচ্ছে। এখন অন্য সূত্রের মধ্যে সঞ্চয়পত্র যেটা ছিল, সেখান থেকে গত বছরে টার্গেটের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ নেয়া হয়েছিল।এরপর সরকার সঞ্চয় পত্র নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। সেজন্য মানুষ এবার সঞ্চয়পত্র কম কিনেছে। সুতরাং সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ পাচ্ছে না।’
মি: রহমান আরও বলেছেন,‘শেয়ার বাজারেও অনুকুল পরিস্থিতি নাই। ষেয়ার বাজারেও সরকার টাকা তোলার জন্য যেতে পারছে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটাতে গেলে তাতে মূল্যস্ফীতি হবে। এরকম একটা অবস্থায় ব্যাংকের ওপর তারা ভর করেছে।’
সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব কি হবে?
ব্যাংকের ওপর সরকারের এই ভর করার প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদরা বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে নানা আশংকার কথা বলছেন। তারা মনে করেন, সরকারের এই ঋণ নেয়ার মাত্রা অব্যাহত থাকলে বড় সংকটে পড়বে ব্যক্তি বা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ। কারণ ব্যাংকগুলো ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণ দেয়া কমিয়ে দেবে।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর নাজনীন আহমেদ বলছিলেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
‘রাজস্ব আদায় বছরের দ্বিতীয় ধাপে কিছুটা বাড়ে। তবে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পুরো অর্জিত হবে, এটা কেউই আসলে এখন মনে করছেন না। সেই বিচারে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া ইতিমধ্যে মাত্রা ছাড়িয়েছে। সেটা হয়তো আরও বাড়বে।’
তিনি আরও বলেছেন,‘রাজস্ব ব্যয়তো কমানো যাবে না। বেতন ভাতাতো দিতে হবে। তখন কমানোর জায়গা হবে উন্নয়ন বাজেটের ব্যয়।’
সরকার কি বলছে
সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান পরিস্থিতিকে অর্থসংকট হিসেবে দেখতে রাজি নন।
‘সংকট কিছু আমি দেখছি না। এটাতো কমবেশি হয়। আপডাউন হয়।’
কিন্তু সরকারের ব্যাংক ঋণ নেয়ার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় কম হওয়ার বিষয়কে যে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, সেটা স্বীকার করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী মি: মান্নান।
‘এটা স্বীকার্য অবশ্য যে টার্গেটের চেয়ে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। এর কারণও আছে, যেহেতু এবার টার্গেটটা উচ্চমাত্রার ছিল। কারণ আশা ছিল এবার সরকার নতুন যে ভ্যাট-কর বাস্তবায়ন করলো, এরফলে একটা বড় অংকের টাকা আশা করা হয়েছিলো। সেটা আদায়ের ব্যাপারে হয়তো সকল মেশিনারি পুরোপুরি কাজ করে নাই।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, অর্থবছরের দ্বিতীয় ধাপে অর্থ্যাৎ বাকি কয়েকমাসে রাজস্ব আয় বাড়ানোর তৎপরতা জোরদার করা হচ্ছে, যাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার মাত্রা কমিয়ে আনা যায়। সেই আশা কতটা পূরণ হবে অর্থনীতিবিদদের অনেকেরই তাতে সন্দেহ রয়েছে। সূত্র : বিবিসি।