বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
ইসকন ইস্যুতে দেশি-বিদেশি ইন্ধন থাকতে পারে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা, যে নির্দেশ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও তাদের লেজ রেখে গেছে : তারেক রহমান আইনজীবীকে ‘কুপিয়ে হত্যা করল’ ইসকন সদস্যরা অনির্দিষ্টকালের জন্য সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল বন্ধ ঘোষণা অহিংস গণঅভ্যুত্থানের আহ্বায়কসহ ১৮ জনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনায় যুক্ত থাকলে ছাড় দেয়া হবে না : আসিফ মাহমুদ চিন্ময়কে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে ভারতের বিবৃতি মানুষ কেন তাদের ওপর বিক্ষুব্ধ, গণমাধ্যমের তা স্পষ্ট করা উচিত : নাহিদ ইসলাম

কেন বছরের পর বছর ঝুলে আছে খেলাপি ঋণের হাজারো মামলা

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৩
  • ৫১ বার

ঋণ যেন খেলাপি বা অনাদায়ী না হয়ে যায়, সেজন্য সতর্ক নজরদারি বজায় রাখতে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ।

রোববার (২ এপ্রিল) বাংলাদেশে ব্যাংকের সাথে বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের যে সভা হয়েছে, তাতে এই পরামর্শ দেয়া হয় বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের অর্থ ঋণ আদালতগুলোয় বর্তমানে প্রায় পৌনে এক লাখ খেলাপি ঋণের মামলা ঝুলে রয়েছে, যাতে এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা বছরের পর বছর ধরে চলছে। ফলে একদিকে যেমন ঋণ আদায়ে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না, তেমনি খেলাপির সংখ্যা আরো বড় হচ্ছে।

আলোচনায় অর্থ ঋণের মামলা
রোববারের এ সভায় বিভিন্ন বিষয়ের সাথে খেলাপি ঋণের বিষয়টিও আলোচনায় ওঠে।

মামলার দীর্ঘসূত্রিতায় ব্যাংকগুলোর অর্থ আটকে রয়েছে, সেজন্য এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন কয়েকজন কর্মকর্তা।

ওই বৈঠকে অংশ নেয়া একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে খুব বেশি কিছু আলোচনা হয়নি। খেলাপি ঋণের মতো পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সেজন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার জন্য আর নজরদারি আরো বৃদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক পরামর্শ দিয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ ঋণ আদালতের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের অর্থ ঋণ আদালতগুলোয় খেলাপি ঋণের অভিযোগে ৭২ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় আটকে রয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ, ঋণ আদায় বা এ জাতীয় বিষয়ে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করতে হয়।

২০০৩ সালে এ আদালত গঠনের পর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এতে মোট মামলা হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার। ওইসব মামলায় দাবি করা অর্থমূল্য ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ ৫০ হাজার মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।

এত মামলা কেন হয়েছে?
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্ট এবং আইনজীবীরা বলছেন, কয়েকটি কারণে অর্থ ঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা বেড়েছে।

সাবেক ব্যাংকার মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, যখন ব্যাংকগুলো বুঝতে পারে যে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আর খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে না, চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসাবে তারা মামলায় যায়।

‘দেশে এই মামলার একমাত্র আদালত হচ্ছে অর্থ ঋণ আদালত। ক্রেডিট কার্ড খেলাপি থেকে শুরু করে ছোট বড় কোটি কোটি টাকার ঋণ খেলাপি, সব মামলায় সব ব্যাংককে এই একটি আদালতেই যেতে হয়। যখন ঋণ আদায়ের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়, আমরা আশা ছেড়ে দেই, তখন সেটাকে রাইট-অফ করার জন্যও মামলা করতে হয়। সেই কারণে এখানে কেসের সংখ্যা অনেক বেশি।’

আবার অর্থ ঋণ আদালতে কোনো মামলায় ব্যাংক বিজয়ী হলেও সেটা বাস্তবায়ন করার জন্যও আরেকটি মামলা করতে হয়।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এরকম চারটি আদালত থাকলেও জেলা শহরগুলোয় একটি করে আদালত রয়েছে।

অর্থ ঋণ মামলা পরিচালনাকারী একজন আইনজীবী মোহাম্মদ তরিক উল্লাহ বলেন, ‘ঢাকার অর্থ ঋণ আদালতগুলোর কয়েকটিতে এখনো বিচারক নেই। এটাই আসলে সবচেয়ে প্রধান সঙ্কট।’

সাবেক ব্যাংকার নুরুল আমিন বলছেন, ‘আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রায় নিয়মিতভাবে বিচারক থাকেন না, জনবলের অভাব রয়েছে। ফলে সেখানে জমে জমে মামলার সংখ্যা বাড়ে, মামলার দীর্ঘসূত্রিতাও বাড়ে। কারণ মামলার যেকোনো সময় সীমা নেই। হয়তো শুনানির দিন বিচারক উপস্থিতি নেই। এসব কারণে দিনের পর দিন ধরে মামলা চলতে থাকে। তার সাথে নতুন নতুন মামলা এসে যোগ হতে থাকে।’

ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী, কোনো অনাদায়ী ঋণ অবলোপন করতে হলে আগে মামলা করতে হবে। ফলে ব্যাংক যদি কখনো বুঝতেও পারে যে, এই ঋণ আর আদায়যোগ্য নয়, তাহলে সেটা তাদের হিসাব থেকে বাদ দেয়ার জন্য এবং আদায়ের চেষ্টা করার জন্যও মামলা করতে হয়।

খেলাপি ঋণের মামলায় এত দীর্ঘসূত্রিতা কেন?
আইনজীবী মোহাম্মদ তরিক উল্লাহ বলছেন, মামলাগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলার প্রধান কারণ বিচারক এবং আদালতের লোকবল সঙ্কট। ফলে মামলা হলেও সেখানে কোনো গতি থাকে না।

‘বিচারক না থাকায় হয়তো ঠিকমতো শুনানি হয় না। অনেক সময় বিবাদী পলাতক থাকে, হয়তো দেশের বাইরে চলে গেছে। তখন মামলাগুলো ঝুলে থাকে।’

তিনি আরো বলেন, খেলাপি ঋণ ঠিকমতো আদায় করতে না পারার পেছনে অনেক সময় ব্যাংকের গাফিলতিও দায়ী হয়ে থাকে। কারণ যখন ঋণ দেয়া হয়ে থাকে, সেখানে যাচাই-বাছাই, সম্পত্তির মূল্যায়ন, ইত্যাদিতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের গাফিলতি দেখা যায়। পরবর্তীতে বিচার কার্যক্রমে গিয়ে বাস্তবের সাথে অনেক কিছুর মিল পাওয়া যায় না।

তরিক উল্লাহ বলেন, ‘হয়ত মর্টগেজের কাগজপত্র ঠিক মতো নেই। হয়ত বন্ধক রাখা সম্পদের মূল্য যতটা দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তার দাম অনেক কম। ফলে নিলাম হলেও দেখা যায়, সেই টাকা উঠে আসে না। ফলে রিকভারি করা নিয়েও অনেক সময় ব্যাংকের ভেতরে অনীহা থাকে।

সাবেক ব্যাংকার নুরুল আমিন বলছেন, ব্যাংক তার পক্ষে আদেশ পাওয়ার পর যখন সেটা কার্যকর করার বা টাকা আদায়ের চেষ্টা করে, তখন অনেকে উচ্চ আদালতে গিয়ে ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিট করেন। ফলে সেসব আদেশের বাস্তবায়নও দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে পড়ে যায়।

বাংলাদেশের একটি গবেষণা সংস্থা সিপিডির হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ অর্থবছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২৭.২৫ বিলিয়ন টাকা। আর ২০২৩ অর্থবছরে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকায়।

দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও নানা সময়ে নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেসরকারি কিছু ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পাচারের অভিযোগ উঠেছে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাদায়ী ঋণের একটি বড় কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই না করেই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে বড় আকারে ঋণ অনুমোদন দেয়া।

সমাধানে কী করা যেতে পারে?
ব্যাংকাররা বলছেন, এসব সমস্যার সমাধান করতে হলে অর্থ ঋণ আদালতে বিচারক ও অন্য জনবলের উপস্থিতি নিয়মিত করতে হবে। সেই সাথে এসব মামলার বিচারকার্য কতদিনের মধ্যে শেষ করতে হবে, এরকম একটি সময়সীমা বেধে দেয়া উচিত।

যারা উচ্চ আদালতে গিয়ে অর্থ ঋণ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে রিট করেন, সেসব রিটের আগে মোট ঋণের একটি অংশ জমা দিয়ে রিট করার বিধান যুক্ত করার পরামর্শ ব্যাংকাররা। তাহলে এভাবে আইনের সুযোগ নিয়ে ঋণ অনাদায়ী রাখার প্রবণতা বন্ধ হবে বলে তিনি মনে করেন।

আইনজীবী মোহাম্মদ তরিক উল্লাহ বলছেন, ঋণ দেয়ার সময়েই ভালো করে যাচাই-বাছাই করতে হবে, তিনি ঠিকমতো ঋণটি ফেরত দেবেন কিনা। যেসব সম্পত্তি তারা বন্ধক দেবে, সেটার মূল্যমান বা বাজারদরও ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে।

তবে ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেশি। এর পেছনে রাজনৈতিক যোগাযোগ, ব্যাংকের পরিচালকদের সহায়তা ইত্যাদি কাজ করে। ফলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে তারা ঋণ পেয়ে যান।

রোববার ব্যাংক পরিচালকদের সাথে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক পরামর্শ দিয়েছে, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেই ব্যাংক যেন আরো সতর্ক হয় এবং নজরদারি আরো বাড়ায়।

এর আগেও এরকম তাগিদ দেয়ার পরেও বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের চিত্রে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। বরং প্রতিবছর খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে।

অর্থ ঋণ আদালতে ২০২২ সালে খেলাপি ঋণের কারণে মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৪৫২টি, যেখানে ৩৫ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা ব্যাংকগুলো দাবি করেছে।

খেলাপি ঋণ আদায়ে ২০১৯ সালে ‘অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশের সরকার। যেখানে খেলাপি ঋণের জন্য পৃথক আদালত তৈরি করা, খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের হালনাগাদ তথ্য নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করার মতো প্রস্তাবনা ছিল, যদিও তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

সাবেক ব্যাংকার নুরুল আমিন বলছেন, ‘অনেকে খেলাপি হওয়াকে একটা মডেল হিসাবে নিয়েছেন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে। তাদের লক্ষ্যই থাকে নানা কৌশলে ফাঁকফোকর জেনে বুঝে ব্যবহার করে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া, কারণ তারা মনে করেন আইনের দিক থেকে তারা সুবিধা পাবেন, ব্যাংক দুর্বল থাকবে। ফলে তাদের ঋণ ফেরত না দিলেও চলবে।’

‘কারণ ব্যাংকের হাতে যে অস্ত্রগুলো আছে, সেগুলো পরিপূর্ণ ব্যবহার করেও যখন আপনি ঋণ ফেরত পাবেন না, সমাধান পাবেন না, তখন হয় আপনাকে নতুন উপায় বের করতে হবে, না হলে বর্তমান উপায়গুলোকে সংস্কার বলেন আর ব্যবস্থা বলি, সেই চেষ্টা করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘কারণ খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংককে দুর্বল করে তোলে, ব্যাংক তার ঋণ ধেয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে, তার প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে।’

সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com