বার্ষিক আরবি পঞ্জিকা ঘুরে মু’মিন মুসলমানের দরজায় কড়া নাড়ে মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাসের সম্মানে আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য খুলে দেন রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের দরজাগুলো। বান্দার প্রতি প্রদর্শন করেন বিশেষ ইহসান। রমজানে সিয়াম সাধনা ছাড়াও রয়েছে বিশেষ কিছু আমল। তন্মধ্যে ইতিকাফ অন্যতম।
ইতিকাফ অর্থ আটকে রাখা, মগ্ন থাকা, কোনো জিনিসকে আঁকড়ে ধরা। পরিভাষায় বলা হয়- ‘আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় মসজিদের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে সেখানে অবস্থান করা এবং দুনিয়াবি সব কর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখা।’ আল্লাহ তায়ালা ইতিকাফ সম্পর্কে বলেন- ‘(আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈল আ:-কে অঙ্গীকারবদ্ধ করলাম যে, তোমরা উভয়ে আমার (কাবা) গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।’ (সূরা বাকারাহ-১২৫)
ইতিকাফের সূচনা : প্রাচীনকাল তথা হজরত ইবরাহিম আ:-এর যুগ থেকেই ইতিকাফের সূচনা হয়। আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহিম ও ইসমাঈল আ:-কে ইতিকাফকারীদের জন্য কাবাঘর পবিত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনটিই কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরা উভয়ে আমার (কাবা) গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।’ (সূরা বাকারাহ-১২৫) জাহেলি যুগে ইতিকাফের প্রচলন ছিল এবং ইসলাম আগমনের পরও তা বহাল থাকে। উমর রা: থেকে বর্ণিত- ‘জাহিলি যুগে তার এক রাত ইতিকাফ করার মান্নত ছিল। তিনি এ সম্পর্কে নবী সা:-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে ইতিকাফ করার নির্দেশ দেন।’ (সহিহ বুখারি-২০৩২)
ইতিকাফ তিন প্রকার : প্রথম প্রকার ওয়াজিব ইতিকাফ কেউ যদি কোনো কারণবশত ইতিকাফের মান্নত করে তাহলে তার ওপর ওই মান্নত পূরণার্থে ইতিকাফ করা ওয়াজিব।
দ্বিতীয় প্রকার মুস্তাহাব ইতিকাফ; এক বা দু’দিন নফল ইতিকাফকে বলা হয়।
তৃতীয় প্রকার সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া ইতিকাফ। ওই ইতিকাফকে বলা হয় যা রমজানের শেষ দশকে করা হয়। রাসূল সা: সারা জীবন রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন তবে জীবন সায়াহ্নের বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেন- ‘রাসূল সা: প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন।’ (সহিহ বুখারি-২০৪৪) তবে উম্মতের ইজমা কর্তৃক ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়ার অন্তর্ভুক্ত। যা গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে যেকোনো একজন পালন করলে সবাই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউ যদি পালন না করে তাহলে সুন্নাতের খেলাপ হবে।
ইতিকাফের ফজিলত : শরিয়তে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের ফজিলত অনেক। নবী সা:-এর হাদিসে রমজানে সিয়াম সাধনার ফজিলতের পাশাপাশি ইতিকাফেরও বেশ ফজিলত বর্র্ণনা করা হয়েছে। হুসাইন ইবনে আলী রা: সূত্রে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, সে যেন দু’টি হজ ও দু’টি ওমরাহ করেছে।’ (কাশফুল গুম্মাহ, পৃষ্ঠা- ১/২১২)
অন্য এক হাদিসে ইতিকাফকারীর জন্য এসেছে মহা সুসংবাদ! ইবনে আব্বাস রা: সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেন, ‘ইতিকাফকারী ইতিকাফের কারণে গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং সব নেকির সওয়াব অর্জন করে।’ (আল মুগনি-৩/৪৫৫) সামান্য কয়েক দিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করলেই তিনি বান্দার জীবনের সব গুনাহ ক্ষমা করবেন আর পূর্ণ করে দেবেন আমলনামা। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়তো আর কিছুই হতে পারে না।
সহিহ নিয়তে ইতিকাফকারীকে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম থেকে দুই দিগন্তেরও বেশি দূরে রাখবেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি।’ (বায়হাকি)
ইতিকাফে কোথায় অবস্থান করবে : ইতিকাফকারী এমন মসজিদে অবস্থান করবে যেখানে জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। তন্মধ্যে সর্বোত্তম স্থান হলো বাইতুল্লাহ শরিফ। অতঃপর মসজিদে নববী, অতঃপর বাইতুল মাকদিস। আর যদি এ তিনটি মসজিদের কোনোটিতেই অবস্থানের সুযোগ না হয় তাহলে নিজ আয়ত্তাধীন সবচেয়ে বড় মসজিদে অবস্থান নেয়া মুস্তাহাব।
ইতিকাফ সহিহ হওয়ার মৌলিক শর্ত : এক. ইতিকাফের পরিশুদ্ধ নিয়ত করা; দুই. পুরুষের জন্য মসজিদে ও নারীদের জন্য ঘরে অবস্থান নেয়া; তিন. নাজাসাতে গলিজা তথা বড় নাপাকি থেকে বেঁচে থাকা; চার. রোজা অবস্থায় থাকা।
ইতিকাফ অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ : ইতিকাফ অবস্থায় এমন কিছু কাজ রয়েছে যা শরিয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি যদি সেসব কাজে যুক্ত হয় তাহলে তার ইতিকাফ বাতিল বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। হজরত আয়েশা রা: বলেন, ইতিকাফকারী এ নিয়ম পালন করবে ‘সে যেন কোনো রোগী দেখতে না যায়, কোনো জানাজায় শরিক না হয়, স্ত্রী সহবাস না করে, স্ত্রীর সাথে মেলামেশা না করে, প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের বাইরে বের না হয়, সওম ছাড়া ইতিকাফ না করে ও জামে মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ইতিকাফ না করে।’ (আবু দাউদ-২৪৭৩)
লেখক :
শিক্ষার্থী, জামিয়াতুস সুন্নাহ, শিবচর, মাদারীপুর