ভারতের উত্তরপ্রদেশে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগে ওই রাজ্যের সরকার অভিযুক্তদের ছবি ও নাম-ধাম দিয়ে যে সব বিশাল বিলবোর্ড রাজধানী জুড়ে লাগিয়েছে, আদালতের স্পষ্ট নির্দেশের পরও সেগুলো সরানো হয়নি।
যোগী আদিত্যনাথ সরকারের ওই সব ফেস্টুন লাগানোর সিদ্ধান্তকে নাগরিকদের ‘ব্যক্তি স্বাধীনতার লঙ্ঘন’ বলে বর্ণনা করে এলাহাবাদ হাইকোর্ট গতকালই সেগুলো সরিয়ে দিতে বলেছিল।
কিন্তু রায়ের পর চব্বিশ ঘন্টারও বেশি কেটে গেলেও লখনৌতে সে সব বিলবোর্ড এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। পাশাপাশি বিজেপি নেতৃত্ব ও রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারাও এই ‘নেমিং অ্যান্ড শেমিং’-য়ের পক্ষে ক্রমাগত সওয়াল করে যাচ্ছেন।
সোমবার বিকেলে এলাহাবাদ হাইকোর্ট উত্তরপ্রদেশ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে যে রায় দিয়েছে তা ছিল অনেক দিক থেকেই বিরল। প্রথমত, অভিযুক্তদের নাম ও ছবি এভাবে প্রকাশ করার বিরুদ্ধে আদালত কারও পিটিশন দাখিলের অপেক্ষা করেনি, তারা ব্যবস্থা নিয়েছে নিজে থেকেই। এমন কী, মামলার শুনানি হয়েছে রবিবার ছুটির দিনেও।
এ বিষয়ে বিচার করার কোনও এক্তিয়ার আদালতের নেই, উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই যুক্তিও খারিজ করে দিয়ে আদালত বলেছে এটা আসলে প্রশাসনের ‘নির্লজ্জ কর্মকান্ডের’ নিদর্শন। কিন্তু এর পরও আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে আদিত্যনাথ সরকার একটি বিলবোর্ডও এখনও পর্যন্ত সরায়নি।
বরং মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা শলভমণি ত্রিপাঠী জানাচ্ছেন, “পোস্টারের এই মুখগুলোকে তো আমরা সবাই চিনি – এরাই তো লখনৌ আগুন লাগাতে চেয়েছিলেন।”
“আর সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ আদায়ের হক আমাদের অবশ্যই আছে। আমরা বিচারবিভাগের মর্যাদা দিই, এবং সব আইনি রাস্তাই কিন্তু আমাদের সামনে খোলা আছে।”
এদিকে রাজ্যের যে অর্ধশতাধিক নাগরিকের নামে রাজ্য সরকার এই পোস্টার দিয়েছে, তারা কিন্তু বলছেন এতে তাদের গোটা পরিবারকেই প্রবল বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
অ্যাক্টিভিস্ট ও অভিনেত্রী সাদাফ জাফর যেমন বলছিলেন, “আমরা অভিযুক্ত হতে পারি, কিন্তু দোষী সাব্যস্ত হইনি – কিন্তু আমাদের ছবি লাগিয়ে সরকার তো আমাদের দোষী বানিয়ে দিচ্ছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই আমরা দোষী, আমাদের বাচ্চারা কী দোষ করেছে – কেন আমাদের বাড়ির ঠিকানা পোস্টারে দেওয়া হবে? ক্ষিপ্ত এক জনতার সামনে সরকার যেভাবে আমাদের আক্রমণের নিশানা বানাতে চাইছে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক!”
লখনৌর থিয়েটার শিল্পী দীপক কবীরও জানাচ্ছেন, “বারবার বলছি আমরা সম্পূর্ণ নির্দোষ। নির্দোষ বলেই আঠারোটা মামলা দিয়েও পুলিশ আদালতে আমাদের জামিন ঠেকাতে পারেনি। আর যে টাকা ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা সরকার খরচ করেছে এই সব বিলবোর্ড তৈরি করে টাঙাতে। একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে আমাদের গণপিটুনির দিকে ঠেলে দেওয়াই তাদের আসল লক্ষ্য।”
সরকার এভাবে নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে না, আদালত তা জোর দিয়ে বললেও শাসক দল বিজেপি কিন্তু বিতর্কটা ঘুরিয়ে দিতে চাইছে সরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির প্রশ্নে।
দলের মুখপাত্র শাজিয়া ইলমি যেমন বলছেন, “রাজ্য সরকারের সিইও বা প্রধান প্রশাসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের মানুষকে এটা শেখানোর পূর্ণ অধিকার আছে যে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করলে তার ফল ভুগতে হবে। এর মধ্যে দয়া করে কেউ ধর্ম বা দলীয় রাজনীতি দেখতে যাবেন না, কারণ এই ধরনের মানসিকতাই আসলে সর্বনাশ ডেকে আনছে।”
কিন্তু এই বিলবোর্ড বিতর্কে উত্তরপ্রদেশ সরকার যেভাবে উচ্চ আদালতকে লাগাতার উপেক্ষা করার স্পর্ধা দেখিয়ে যাচ্ছে, সেটা আসলে ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য অনেক বড় বিপদের অশনি সংকেত বলেই বহু পর্যবেক্ষকের অভিমত। বিবিসি।