মাধ্যমিক পর্যায়ের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত নতুন কারিকুলামের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন অধ্যায়ের গল্প এবং ছবিতে আমাদের চিরাচরিত পারিবারিক শাসনকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও আমদের পারিবারিক ও সামাজিক দিক বিবেচনায় সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের অনুশাসন শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতার অন্যতম অনুসঙ্গ। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের বর্ণনায় বাবা-মায়ের এই শাসনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের কয়েকটি অধ্যায় পড়লে দেখা যাবে এখানে শিশুদের পারসোনাল স্পেসের নামে পারিবারিক অনুশাসনকে মন্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর একটি ছাত্র বা ছাত্রী কি পড়ছে বা মোবাইলে তারা কি দেখছে এগুলো যদি তাদের বাবা মা মনিটরিং করেন বা খোঁজখবর বা খেয়াল রাখেন তাহলে এটাকে বলা হচ্ছে বাবা বা মায়ের অনধিকার চর্চা। অথচ পশ্চিমা সমাজের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে আমাদের মুসলিম ও বাঙালি সমাজে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আমাদের কোমলমতি শিশুদের চরিত্র ধ্বংসের সব আয়োজন করা হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণীর একটি গল্পের শুরুটা এমন, আমিন নামের এক কিশোর পেয়াজ এনে দেয়ার পর সে ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে একটি গল্পের বই পড়া শুরু করল। কিন্তু আমিনের বাবা রহমান যখন আমিনের ঘরে প্রবেশ করে সে (আমিন) কি করছে বা পড়ছে তা জানতে চাইল তখন আমিন অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলল, আমি আমার মতো করে ঘরে একা থাকতে চাইছিলাম। একটি গল্পের বই পড়ছিলাম ।
একপর্যায়ে আমিন তার বাবাকে বলল আমি ঘরে একা থাকার পর কেউ যদি আমার ঘরে উঁকিঝুঁকি মারে কিংবা আমার ঘরে প্রবেশ করে তখন আমার অস্বস্তি লাগে। এতে কি বুঝা গেল? নি:সন্দেহে একজন বাবা তার ছোট কিশোর ছেলে কী করছে কী পড়ছে তার দেখভাল করার অধিকার রাখে কিংবা এটা প্রত্যেক বাবা কিংবা মায়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এই গল্পে এটাকে নিরুৎসাহিত করে আমাদের ঘরের প্রত্যেকটি শিশু সন্তানের মনে বাবা-মায়ের মনিটরিং বা শাসনকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে আমাদের সন্তানদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রেখেও আমাদের সন্তানদের নিরাপদ মনে করছি না। অথচ পারিবারিক শাসনকে পাঠ্যবইয়ের পাতায় কিভাবে পদদলিত করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণীর একটি গল্পে ফাহিম ও অন্তরার সম্পর্কের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও তারা দুজন দুটি ভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করে । কিন্তু তাদের মধ্যে প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হতো। বিষয়টি তাদের বাবা-মা জানার পর দুজনের পরিবারই তাদের শাসন করে। কিন্তু পারিবারিক এই শাসনকে সপ্তম শ্রেণীর গল্পে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গল্পে ফাহিম এবং অন্তরার এই বন্ধুত্ব ও তাদের মধ্যে যোগাযোগ বা দেখা সাক্ষাতকে স্বাভাবিকভাবে দেখানো হয়েছে। যদিও আমাদের সমাজব্যবস্থায় উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের ক্লাসরুমের বাইরে এই যোগাযোগ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কেননা আমাদের সন্তানদের নৈতিকভাবে গড়ে তোলা এমনিতেই আমাদের প্রত্যেকের জন্যই দুরূহ ও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে যেভাবে এসব বিষয়কে তুলে আনা হয়েছে তাতে আমাদের সন্তানদের নৈতিকভাবে এবং চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের বাবা মায়েদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে আমার মনের জানালা গল্পের ৭৭ পৃষ্ঠা থেকে ৮০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মেয়েদের মাসিকের যেভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের মা-খালা বা চাচীরাও এভাবে বর্ণনা করতে ইতস্ততবোধ করবে। পাঠ্যবইয়ে ছেলে-মেয়েদের একই ক্লাসে শিক্ষক যদি বইয়ের এই ভাষায় বর্ণনা করেন তাহলে শালীনতাবোধ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। অপরদিকে অষ্টম শ্রেণীর অপর আরো একটি গল্পে সাথী নামের এক শিক্ষার্থীর মন ভালো না মর্মে একটি গল্পের বর্ণনা শুরু করা হয়েছে। এই গল্পেও সাথীর মা সাথীকে তার মাসিকের কারণ ও এ সময়ে করনীয় সম্পর্কে তাকে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু স্কুলে এসে সাথী চাইছে বিষয়টি তার কোনো সহপাঠীর সাথে আলোচনা করতে। এতে তার মন ভালো হয়ে যাবে এমন একটি দীক্ষা পাঠ্যবইয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে একজন সচেতন মাকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনার আবর্তে আমাদের সন্তানদের শালীনতা এবং সন্তানদের প্রতি মায়ের যে নির্দেশনা বা শাসন সব কিছুই যেন এক ঝটকায় কেড়ে নেয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
রাখী নামের ১৪ বছরের অপর একটি মেয়ের ঘটনা নিয়ে একটি গল্প বর্র্ণনা করা হয়েছে। এই গল্পে রাখীর ছোট হয়ে যাওয়া জামা পরা নিয়ে মায়ের নিষেধকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার এই একই গল্পে রাখী স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলা করে দেরিতে বাড়িতে ফেরার পর বাবার অনুশাসনকেও নেতিবাচক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ১৪ বছরের একটি মেয়ে স্কুল ছুটির পর বাড়িতে চলে আসবে এটাই আমাদের সমাজব্যবস্থায় বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত একটি বিষয়। ১৪ বছর বয়সের একটি মেয়ের শারীরিক এবং মানসিক কিছু পরিবর্তন আসবে এবং এই সময়ে প্রত্যেক বাবা-মা অবশ্যই তার মেয়ের দিকে একটি বাড়তি নজর রাখবেন এটাই একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে এই ঘটনাটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে রাখীর বাবার অনুশাসনকে ভুল প্রমাণিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মো: বরকত আলী গতকাল মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে বলেন, পারিবারিক অনুশাসন আমাদের সমাজের ঐতিহ্যেরই একটি অংশ। কিন্তু একটি চক্র আমাদের প্রজন্মকে ধ্বংস করার হীন অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার মাধ্যমেই বিগড়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। বিশেষ করে সভ্যতার দ্বন্দ্ব থেকেই পশ্চিমা একটি গোষ্ঠীর এই অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যেখানে প্রাচীনকাল থেকে আমরা আমাদের সন্তানদের আদর ভালোবাসার সাথে শাসনের মাধ্যমে গড়ে তুলছি সেখানে এখন পারিবারিক শাসনকেই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটা অবশ্যই ভালো কোনো লক্ষণ নয়। আমি স্পষ্টতই মনে করি আমাদের প্রজন্মকে নিথর, চিন্তাহীন ও অসাড় একটি জাতি গঠনের জন্যই একটি সুদূরপ্রসারী চক্তান্ত হচ্ছে। যেখানে একটি জাতিসত্ত্বা গড়ে উঠতে শত বছরের চেষ্টা সাধনার প্রয়োজন হয়, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ ঢুকিয়ে দিতে পারলে মাত্র ৪০/৫০ বছরেই সেই জাতিবিনাশী চেষ্টা সফল হয়ে যেতে পারে। কাজেই আমাদের অভিভাবকদেরও এ ক্ষেত্রে সচেতনভাবেই সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় আমাদের আগামী প্রজন্মের যে ক্ষতি হবে তা হয়তো হাজার বছরেও শোধরাবার সুযোগ আর থাকবে না।