দেশে প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা যাচ্ছেন যথাসময়ে আইসিইউ সেবা না পেয়ে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিতে দেশব্যাপী ৩৯৯টি আইসিইউ ইউনিট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কিন্তু রোগীর চাপে তার কোনটিই ফাঁকা পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর লক্ষণ আছে এমন রোগীকে নন-কোভিড হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি নেয়া হচ্ছে না।
ঢাকার বারডেম হাসপাতালের কর্মকর্তা ফরিদ কবিরের মা টানা দুই দিন পেটের সমস্যায় ভুগে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু এটি করোনাভাইরাসের লক্ষণ হওয়ায় কোন নন-কোভিড হাসপাতাল তাকে ভর্তি করতে রাজি হননি।
একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার যোগাযোগে কোনভাবে একটি শয্যা যোগাড় করতে পারলেও ততদিনে ফরিদ কবিরের মায়ের অবস্থা এতোটাই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে যে চিকিৎসকরা দ্রুত আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দেন।
কিন্তু ঢাকার সমস্ত আইসিইউ সমৃদ্ধ হাসপাতালে চেষ্টা করেও তার মাকে ভর্তি করতে পারেননি।
শেষ পর্যন্ত একটি আইসিইউ পেলেও ততোক্ষণে রোগীর অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
ফরিদ কবির বলেন, “আইসিইউ পেতে আমাদের যে সময় লাগলো, সেটা একজন রোগীকে সংকটে ফেলতে যথেষ্ট। ২৪ ঘণ্টা দেরী হলেই রোগী মরণাপন্ন হয়ে যান। আমার মায়ের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। সঠিক সময়ে আইসিইউ পেলে আমি আমার মাকে বাঁচাতে পারতাম। এই দায় সরকার এড়াতে পারে না।”
এমন আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন পেশায় চিকিৎসক ড. আলী তারেক। গতকাল সারাদিন তিনি তার বাবাকে আইসিইউতে ভর্তির জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরলেও কোথাও জায়গা পাননি। এমনকি নিজের হাসপাতালেও না। আজ কোনভাবে একটি আইসিইউ পেলেও তার বাবার পরিস্থিতি বেশ সংকটাপন্ন বলে তিনি জানিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পাঁচ শতাংশ জটিল রোগীর আইসিইউ শয্যার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনের তুলনায় আইসিইউ শয্যার সংখ্যা আগে থেকেই কম বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান।
জেলা উপজেলা পর্যায়ে আইসিইউ নেই বললেই চলে।
বর্তমানে প্রতিদিন যে হারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের চাহিদা। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও আইসিইউ সেবা বাড়েনি।
এ ব্যাপারে হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, বর্তমানে তারা নতুন আইসিইউ স্থাপনে নয়, বরং যে আইসিইউ ইউনিট রয়েছে সেগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, “নতুন অবকাঠামো করতে সময় লাগবে। চেষ্টা করছি যেটা আছে, সেটারই সর্বোচ্চ ব্যবহারের। এখন আইসিইউ এর চাইতে অক্সিজেনের সরবরাহ বেশি প্রয়োজন। প্রতিটি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশব্যাপী প্রায় ১২০০টি আইসিইউ ইউনিট রয়েছে, এরমধ্যে ৩৯৯টি কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের জন্য বরাদ্দ করা আছে।
তবে এসব আইসিইউ এর সবগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অর্থাৎ একটি আধুনিক আইসিইউ ইউনিটে যে ধরণের আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল প্রয়োজন সেটা সব জায়গায় নেই।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দেশের সব জেলা হাসপাতালে দ্রুত স্বয়ংসম্পূর্ণ আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন।
কিন্তু এ ধরণের আধুনিক আইসিইউ ইউনিট এবং দক্ষ জনবল রাতারাতি গড়ে তোলাও সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ।
“আইসিইউ একটি বিশেষায়িত সেবা। দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবল ছাড়া এই সেবা দেয়া যায় না। বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোন ডিগ্রী নেই। নতুন করে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতেই পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগবে।”
এমন অবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের যেন আইসিইউতে ভর্তি হতে না হয় সেজন্য প্রতিরোধের ওপর বেশি জোর দিতে দিতে বলেছেন তিনি। যাতে রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
রোগী এই হারে বাড়তে থাকলে, কোনভাবেই সামাল দেয়া সম্ভব না বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এক্ষেত্রে তিনিও জেলা উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতিটি হাসপাতালে অক্সিজেন সেবা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের খুব বেশি শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাদেরকে তৎক্ষণাৎ আইসিইউতে নিতে হয়।
অথচ প্রতিদিন একটি আইসিইউ শয্যা পেতে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে একাধিক রোগীকে। কে কোন সময়ে এই সেবা পাচ্ছেন সেটাই গড়ে দিচ্ছে তাদের জীবন-মৃত্যুর তফাৎ। বিবিসি