যুক্তরাষ্ট্রে ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং বিতর্কিত নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ এবং আল গোরের মধ্যে এই নির্বাচনে ভোট গণনা নিয়ে তৈরি হয়েছিল তীব্র বিবাদ এবং অনেক আইনি লড়াইয়ের পর নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছিল সুপ্রিম কোর্ট থেকে। এ নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্বটি তৈরি করেছেন রেবেকা কেসবি।
এরকম নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র আর কখনো দেখেনি। দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান এতটা কম আর কখনো ছিল না। নির্বাচনের ফল ঘিরে এক মাস ধরে চলেছিল অনেক নাটকীয় ঘটনা।
ক্যালি শেল তখন কাজ করছিলেন আল গোরের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অফিশিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে।
“সারা দেশ ঘুরে নভেম্বরের ৭ তারিখে, রাত দুটা বেজে ৩০ মিনিটে, শেষ সমাবেশটা আমরা করেছিলাম ফ্লোরিডায়। এটা খুবই অদ্ভুত একটা ব্যাপার যে, শেষ নির্বাচনী সভা হয়েছিল ফ্লোরিডায়, আর নির্বাচনের ফল শেষ পর্যন্ত আটকে গিয়েছিল এই ফ্লোরিডাতেই।”
সেবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন আল গোর। এর আগে তিনি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে আট বছর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আর রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ছিলেন জর্জ ডাব্লিউ বুশ। তিনি এর আগে টেক্সাসের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আশা করছিলেন, তার বাবা জর্জ বুশের মতো তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন।
কিন্তু নভেম্বরের ৭ তারিখে ভোটের দিন পর্যন্ত এই নির্বাচনে কে জিতবে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। কারণ জনমত জরিপে দুজনের ব্যবধান ছিল খুবই কম।
ক্যালি শেলের মতে, আল গোর শিবির ছিল বেশ আশাবাদী, খুবই উদ্দীপ্ত। তবে তারা ধরে নিচ্ছিল না যে, জয়টা তাদেরই হতে যাচ্ছে।
“আমি জানতাম, তারা বেশ নার্ভাস ছিল। কারণ প্রার্থী যখন তার বক্তৃতা নিয়ে কাজ করেন, তখন সেখানে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়া হয়। কিন্তু আল গোর শিবিরের লোকজন সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতে দেয়নি, যেটা বেশ অস্বাভাবিক। ভোটের যে হিসেব আসছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল একেবারে হাড্ডহাড্ডি লড়াই হচ্ছে, দুই প্রার্থীর ব্যবধান খুবই কম।”
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজ বলে যে পদ্ধতি চালু আছে, তাতে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিটি রাজ্যের জন্য ঠিক করা হয় ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা। কিছু রাজ্যের ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা মাত্র তিনটি বা চারটি। আবার বড় রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা ৫০-এর বেশি।
২০০০ সালে ফ্লোরিডার ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ছিল ২৫টি। কাজেই সেবার নির্বাচনে অন্য সব রাজ্যের ফলে যখন দুই প্রার্থীর ব্যবধান খুবই কম, তখন ফ্লোরিডাতেই এই নির্বাচনের ফল নির্ধারিত হতে যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন টাইম রাত আটটার সময় বড় কয়েকটি টিভি নেটওয়ার্ক ঘোষণা করে বসলো, ফ্লোরিডায় জিতেছেন আল গোর। তার মানে তিনিই প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন।
আল গোর এবং তার পরিবার যখন এই খবর শুনছিলেন, তখন সেখানে ছিলেন ফটোগ্রাফার ক্যালি শেল।
“তখন বাচ্চারা করিডোর ধরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। আল গোর শিবিরের কর্মীরা একে অন্যকে আলিঙ্গন করছিল। আল গোর কেবল তার হাতটা নিজের মাথার ওপর রেখে বললেন, এটা আসলেই একটা বিরাট ব্যাপার… । কিন্তু তারপরই আল গোরের কাছে ফোন কল আসতে লাগলো তার ক্যাম্পেইন ম্যানেজারের কাছ থেকে। ক্যাম্পেইন ম্যানেজার বলছিল, এই ফল বার বার পাল্টে যাচ্ছে। তারপর সাংবাদিকরাও বলতে শুরু করলো, ফ্লোরিডায় অনেক বড় ঝামেলা আছে…”
ফ্লোরিডার বিভিন্ন দিক থেকে তখন যে ধরনের খবর আসছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল, আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হতে যাচ্ছেন, সেটা জানতে বেশ দেরি হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যালট পেপার একেক রাজ্যে একেক রকম। এমনকি তাদের ভোট দেয়ার নিয়ম-কানুনও একেক জায়গায় একেক রকম।
একই রাজ্যেই হয়তো কোন জেলায় ভোট নেয়া হচ্ছে ইলেকট্রনিক মেশিনে, কোথাও ব্যালট পেপারে ক্রস চিহ্ন দিয়ে। কোথাও হয়তো একটা পেপারে ছিদ্র করে তারা চিহ্ণিত করছে কাকে ভোট দিচ্ছে। এটাকে বলে চ্যাড। মনে হচ্ছিল টিভি নেটওয়ার্কগুলো যেন তাড়াহুড়ো করে আল গোরকে নির্বাচিত ঘোষণা করে দিয়েছে।
নির্বাচনের ফল নিয়ে অব্যাহতভাবে চলছিল নানা জল্পনা। সেই সঙ্গে বিভ্রান্তি। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সবাই তখন প্রচন্ড স্নায়ু চাপে ভুগছে।
ক্যালি শেলের মনে আছে, আল গোর তখন খুব শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলেন। তিনি তখন হোটেল রুমের মেঝেতে শুয়ে পুরো বিষয়টির মানে বোঝার চেষ্টা করছিলেন।
এরপর মধ্যরাতের একটু পর, টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলো এবার উল্টো ফল ঘোষণা করতে লাগলো, তারা বললো ফ্লোরিডায় আসলে জিতেছেন জর্জ ডাব্লিউ বুশ।
আল গোর শিবিরে যেন বিপর্যয় নেমে এলো।
“মনে হচ্ছিল এটি যেন এক শবযাত্রা। সবাই যেন পাথর হয়ে গেছে। আড়াইটার সময় আল গোর একা তার স্যুইটের বেডরুমে গিয়ে বুশকে ফোন করলেন এবং পরাজয় স্বীকার করলেন। বুশকে অভিনন্দন জানালেন।”
“তখন সেখানে এতটাই নীরবতা যে, একটি পিন মেঝেতে পড়লে মনে হয় যেন সেটার শব্দ শোনা যাবে। কেউ কিছু বলছিল না। আমার মনে হয় সবাই একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনে জেতার জন্য দেড় বছর ধরে সবাই কষ্ট করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে হারতে হলো ।”
তারপর আল গোর যখন হার স্বীকার করে বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তার টিমের কাছে একটি বার্তা এলো।
“তার দলের একজন কর্মীর কাছে একটা টেক্সট মেসেজ এলো ক্যাম্পেইন ম্যানেজারের কাছ থেকে। এটিতে বলা হলো, আল গোরকে যেন অনুষ্ঠান মঞ্চে যেতে দেয়া না হয়। কারণ ভোটের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু আল গোর চাইছিলেন, তিনি মঞ্চে গিয়ে বক্তৃতা দেবেন। তিনি বলছিলেন, লোকজন বহু ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে, আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই।
”তখন একটা লোক সবার সামনে গিয়ে বললো, মাইক রেডি নয়, কাজেই সবাই আবার বাইরের রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। এরপর লোকটা আল গোরকে বললো, ফ্লোরিডার ব্যাপারটা এখনো শেষ হয়নি। তখন আল গোর বললেন, কী বললে? আমার মনে আছে, তার মুখের হতবাক অভিব্যক্তি। তারপরই শোনা গেল লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়ছে। আল গোর তখন জানতে চাইলেন, আসলেই তাই? তুমি মজা করছো না তো?”
সেই ফোন কলের কথোপকথন ক্যালি শেলের শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেই মুহূর্তগুলি তিনি ক্যামেরায় বন্দিও করেছেন।
“ছবিতে আপনি যা দেখছেন, সেটা দেখে আসলে ঐ মুহূর্তটা কল্পনা করা কঠিন। আল গোর ছিলেন একটি হেলানো চেয়ারে। পুরো রুমটি মানুষে ঠাসা। সবাই তাকিয়ে আছে। কিন্তু কেউ কথা বলছে না। সবাই দাঁতে নখ কাটছে। তাদের কথোপকথন শোনা যাচ্ছিল। বুশ বলছিলেন, না। এটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু গোর বলছিলেন এটা শেষ হয়নি।
”তাদের দুজনের মধ্যে বাদানুবাদ চলছিল। দুজনের স্বরই ছিল বেশ কর্কশ। কথা শেষ করে আল গোর ফোন রাখলেন, একটু থামলেন, তারপর হাসিতে ফেটে পড়লেন। তখন সবাই হাসছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম এটা তো একটা ঐতিহাসিক ঘটনা.. আমার হাঁটু তখন কাঁপছে। কিন্তু আমাকে তখন ভাবতে হচ্ছিল, আমার শরীর কাঁপলে চলবে না। আমি যেন ঠিকমত ছবি তুলতে পারি। আমি তখন জানি আমার ছবিটা কি হবে। এই ছবিটা হবে ঐতিহাসিক। আমার এই মুহূর্তটা মিস করা চলবে না।”
এরপর ফ্লোরিডার আদালতে শুরু হলো কয়েক সপ্তাহ ব্যাপী এক আইনি লড়াই। পুরো দেশ এবং পুরো বিশ্ব তখন অপেক্ষা করছে- কে হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।
ভোট পুনর্গণনার সময় কয়েকটা সমস্যা দেখা দিল। বিশেষ করে যেসব ব্যালট পেপারে ফুটো করা হয়েছে, সেগুলোতে। যেগুলোকে বলা হয় চ্যাড। একটা ব্যালটে যদি ছিদ্রটা পুরোপুরি না করা হয়ে থাকে, সেটাকে কি গোনা হবে? এগুলোকে বর্ণনা করা হচ্ছিল ঝুলে থাকা বা নড়তে থাকা চ্যাড বলে। ফ্লোরিডার কিছু অংশে ব্যবহার করা হয়েছিল বাটারফ্লাই ব্যালট। এটি আসলে দুই পাতার এক ভোটিং স্লিপ। সেখানে প্রার্থীদের নাম বাম এবং ডানদিকে ছড়ানো। আর চ্যাড বা ছিদ্র করতে হবে মাঝখানে। সমালোচকরা বলছিলেন, অনেকে ভুল করে ভুল প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বসেছেন।
লোকজনকে তখন প্রতিটি ভোট হাতে গুণতে হচ্ছে। রিপাবলিকানরা চাইছিল ভোট পুনঃগণনার কাজটি যেন থামানো যায়। তারা ফ্লোরিডার কোর্টে গেল। কিন্তু ডেমোক্রেটরা বলছিল, না, সবগুলো ভোট পুনর্গণনা করতে হবে। আদালত ভোট পুনর্গণনার পক্ষে রায় দিল।
এই পুরো বিষয়টির জন্য তখন আল গোরের সমালোচনা চলছিল, যে তিনি হার স্বীকার করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। হেরে গিয়ে অভিযোগ তুলছেন। ভোটের ফল চ্যালেঞ্জ করছেন।
কিন্তু ক্যালি শেল বলছেন, ভোট পুনঃগণনার দরকার ছিল।
“আপনি যদি একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশে থাকেন, সেখানে এটা গুরুত্বপূর্ণ। সারা দুনিয়া দেখছে আমরা কি করি। আমরা সারা দুনিয়াকে পরামর্শ দেই কীভাবে নির্বাচন করতে হবে। অথচ দেখা যাচ্ছে, আমরা নিজেরাই ঠিকমত নির্বাচন করতে পারি না বলে প্রমাণিত হচ্ছে।”
ফ্লোরিডার সর্বোচ্চ আদালত রায় দিল, প্রতিটি ভোট হাতে গুণতে হবে। কিন্তু ১২ ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট এই রায় উল্টে দিল। সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারকের ৫ জন ভোট দিলেন ভোট পুনঃগণনা বন্ধ করার পক্ষে, চারজন বিপক্ষে।
আদালত ভোটের প্রথম ফলকেই সঠিক বলে রায় দিলেন। অর্থাৎ ফ্লোরিডায় জর্জ ডাব্লিউ বুশই জিতেছেন। এর ফলে ফ্লোরিডার সবগুলো ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে গেলেন জর্জ ডাব্লিউ বুশ। তার মোট ইলেকটোরাল কলেজ ভোট দাঁড়াল ২৭১… প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যত ভোট দরকার, তার চেয়ে এক ভোট বেশি।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যখন আল গোরের হোয়াইট হাউসে যাওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল, তখন তার কাছেই ছিলেন ক্যালি শেল।
“আইনজীবীরা সবাই তখন ফোনে কথা বলছে। আমার মনে পড়ছে, আল গোর তখন বললেন, সব শেষ হয়ে গেছে, ঠিক? আমরা কি আর কিছু করতে পারি?” আইনজীবীরা বললো, না, সব শেষ, আর কিছু করার নেই। তখন আল গোর বললেন, তাহলে আর কিছু করার নেই, আমাদের সবার এখন ঘুমাতে যাওয়া উচিত। আমার মনে হচ্ছিল, তিনি বেশ দমে গিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল, তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেলে বেশ ভালোই দেশ চালাতে পারতেন। । আমার মনে হয় আল গোর বেশ নিরাশ হয়েছিলেন, যে সিস্টেমের ওপর তিনি এতটা আস্থা রেখেছিলেন, সেটি শেষ পর্যন্ত কাজ করেনি।”
ফটোগ্রাফার ক্যালি শেল এরপর বারাক ওবামার সঙ্গেও কাজ করেছেন, তার ছবি দিয়ে একটি বইও প্রকাশ করেছেন। আল গোর পরবর্তীতে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে তার কাজের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
আর জর্জ বুশ হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩ তম প্রেসিডেন্ট। ২০০৪ সালেও তিনি খুব সহজে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সূত্র : বিবিসি