ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা দাবি করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে হাজার হাজার ভোট দেয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিদের নামে, যারা আসলে মৃত।
এই তথাকথিত ‘মৃত ভোটারদের’ একজন হচ্ছেন মারিয়া আরেডোনডো।
আমরা যখন তাকে ফোন করলাম, তিনি আমাদের বললেন, “আমার বয়স হয়তো ৭২, কিন্তু আমি এখনো বেঁচে আছি এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি। আমার মাথাও ঠিক মতো কাজ করছে এবং আমার স্বাস্থ্য বেশ ভালো।”
মারিয়া আমাদের জানালেন, নির্বাচনে তিনি জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন। তিনি যখন জানলেন, মিশিগানের কথিত মৃত ভোটারদের এক তালিকায় তার নামটিও আছে, মারিয়া খুবই অবাক হলেন।
মারিয়ার মতো আরও অনেক মানুষ, যাদের নাম রয়েছে এই কথিত মৃত ভোটারদের তালিকায়, তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এদের বেলাতেও আমরা মারিয়ার মতো একই ধরণের কাহিনী জানতে পেরেছি।
যুক্তরাষ্ট্রের আগের নির্বাচনগুলোতেও এরকম ঘটনা ধরা পড়েছে যেখানে মনে হয়েছে যেন কোন মৃত ব্যক্তি ভোট দিয়েছে।
এরকম ঘটনা ঘটে মূলত সরকারি নথিপত্রের ভুলে। অথবা এই পরিবারে একই নামে থাকা আরেক ব্যক্তি যখন তাদের ব্যালট পাঠিয়ে ভোট দেন তখন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থকরা অভিযোগ করছেন যে এবারের নির্বাচনে এটা ব্যাপক হারে ঘটেছে।
তাদের এই দাবির পক্ষে কোন প্রমাণ আছে কিনা সেটা জানতে আমরা অনুসন্ধান চালাই।
মিশিগানে দশ হাজার ‘মৃত অনুপস্থিত ভোটার’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক এক রাজনৈতিক কর্মী দশ হাজার লোকের নামের একটি তালিকা টুইটারে পোস্ট করেছিলেন। সেখান থেকেই এই বিতর্কের শুরু।এই তালিকাটি দেখে মনে হবে যেন এরা সবাই মারা গেছে, কিন্তু তাদের নামে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেয়া হয়েছে।
মৃত লোকদের নামে ভোট দেয়ার এই দাবি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যারা এসব দাবি করেছেন তাদের মধ্যে রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচিত অনেক জনপ্রতিনিধিও আছেন।
টুইটারে শেয়ার করা দশ হাজার ‘মৃত ভোটারের’ তালিকায় তাদের নাম, পোস্ট কোড, এবং যে তারিখে তারা ব্যালট পেপার পেয়েছেন তার উল্লেখ আছে।
এরপর সেখানে একটি সম্পূর্ণ জন্ম তারিখ এবং সম্পূর্ণ মৃত্যু তারিখ দেয়া আছে। তালিকা অনুযায়ী কেউ কেউ মারা গেছেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে।
মিশিগানে এমন একটি ডেটাবেজ বা তথ্য ভাণ্ডার আছে যেখানে যে কেউ ঢুকে কারো নাম, পোস্ট কোড, জন্ম মাস, এবং জন্ম বছর দিয়ে যাচাই করে দেখতে পারেন, তারা এবছর ‘অ্যাবসেন্টি ব্যালট’, অর্থাৎ অনুপস্থিত ভোটার হিসেবে ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন কিনা।
যুক্তরাষ্ট্রে এরকম কয়েকটি ওয়েবসাইট আছে, যেখানে সব মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড বা নথিপত্র আছে।
কিন্তু টুইটারে পোস্ট করা ১০ হাজার মানুষের এই তালিকায় একটা মৌলিক সমস্যা আছে।
এসব তথ্যভাণ্ডার দেখে এভাবে একটা তালিকা তৈরির কাজ করতে গেলে একই নামের দুজন ভিন্ন মানুষকে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। যেমন, ১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে জন্ম, এরকম এক ভোটার হয়তো মিশিগানে ভোট দিয়েছেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোন জায়গায় হয়তো ঠিক একই নামে আরেকজন আছেন, যারও জন্ম ১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে, কিন্তু যিনি এখন মৃত।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি বড় দেশে এটা অহরহই ঘটে। কারণ দেশটির জনসংখ্যা হচ্ছে ৩২ কোটি ৮০ লক্ষ। এবং কিছু নাম আছে বহুল ব্যবহৃত, যে নামের অনেক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে।
এই কথিত ‘মৃত ভোটারদের তালিকা’ সঠিক না বেঠিক তা যাচাই করার জন্য আমরা দৈবচয়ন ভিত্তিতে ৩০টি নাম বাছাই করি। এরপর এই ৩০ জনের সঙ্গে আমরা যোগ করি তালিকার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটির নাম।
এই ৩১ জনের মধ্যে ১১ জন যে এখনো বেঁচে আছেন, আমরা তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। আমরা হয় তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পেরেছি অথবা কথা বলেছি তাদের পরিবারের কোনও সদস্য, কোন প্রতিবেশী বা তারা থাকেন এরকম বয়স্ক নিবাসের কর্মীর সঙ্গে।
বাকী ১৭ জনের বেলায় আমরা দেখেছি, তারা যে মারা গেছেন এরকম কোন সরকারি রেকর্ড নেই।
কথিত দশ হাজার মৃত ভোটারের তালিকায় যে তারিখে তারা মারা গেছেন বলে বলা হচ্ছে, আমাদের কাছে পরিষ্কার প্রমাণ আছে যে সেই তারিখের পরও তারা বেঁচে আছেন বা ছিলেন।
এই অনুসন্ধান থেকে এটা একেবারে পরিষ্কার যে, কিছু মানুষের তথ্যের সঙ্গে অন্য কিছু ভুল তথ্য জুড়ে দিয়ে এই ‘মৃত ভোটারদের’ তালিকা তৈরি করা হয়েছে।তবে তালিকার তিন জন মানুষ আমরা পেয়েছি, যারা আসলেই মারা গেছেন। তবে এই তিনজনের ঘটনা আমরা পরীক্ষা করবো একটু পরে।
অনুসন্ধানে আমরা যা পেয়েছি
আমরা প্রথমেই যে কাজটা করেছি, তা হলো, মিশিগানের নির্বাচনী তথ্য ভাণ্ডার যাচাই করে দেখা। এই ৩১ জনের নামে আসলেই ডাকযোগে ব্যালট পেপার পাঠানো হয়েছিল কিনা।
আমরা দেখেছি, আসলেই তাদের প্রত্যেকের নামে ব্যালট পাঠানো হয়েছিল।
এরপর আমরা তাদের মৃত্যুর রেকর্ড যাচাই করে দেখেছি। আর তখনই খুব দ্রুত আমাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হলো। আমরা দেখলাম, এদের বেশিরভাগই আসলে মিশিগানে মারা যাননি। তারা মারা গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোথাও।তখন আমরা ভাবছিলাম, আমরা কি একই নামের লোক মিশিগানে খুঁজে পাবো, যারা এখনো বেঁচে আছেন?
এরপর আমরা মিশিগানের পাবলিক রেকর্ড যাচাই করে তা মিলিয়ে দেখলাম ভোটারদের পোস্টাল কোডের সঙ্গে। যারা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিয়েছেন, আমরা তাদের পূর্ণ জন্ম তারিখ খুঁজে পেলাম এভাবে। এবং আমরা যা ধারণা করেছিলাম তাই ঘটলো। ‘মৃত ভোটারদের’ তালিকায় দেয়া জন্ম তারিখের সঙ্গে এদের জন্ম তারিখ মিলছিল না।
কাজেই আমরা এখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলতে পারি, মৃত ভোটারদের তালিকায় যাদের কথা আছে, আর যারা ভোট দিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে, তারা আসলে একই ব্যক্তি নন। এদের নামটাই শুধু এক।
কিন্তু এরপরও আমরা আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছি।
‘আমি এখনো বেঁচে আছি’
রবার্তো গার্সিয়া মিশিগানের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। আমরা তাকে ফোন করলাম।
তিনি আমাদের বললেন, “আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি বেঁচে আছি এবং আমি জো বাইডেনকেই ভোট দিয়েছি। আমি মরে গেলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারব না।”
আমরা ১০০-বছর বয়স্ক এক নারীকেও খুঁজে পেলাম, যিনি এই মৃত ভোটার তালিকায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৮২ সালে মারা গেছেন। কিন্তু তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং মিশিগানের এক নার্সিংহোমে থাকেন।
তবে আমাদের এই অনুসন্ধানের ফল সব সময় এত সোজাসাপ্টা ছিল না।
আমরা আরেকজন শতবর্ষী মানুষের খোঁজ করছিলাম যিনি এই মৃত মানুষদের তালিকা অনুযায়ী ১৯৭৭ সালে মারা গেছেন। আমরা দেখলাম, সেপ্টেম্বর মাসে যখন তার ব্যালটটি ডাকযোগে পাঠানো হয়, তখনও তিনি বেঁচে ছিলেন।
তবে একজন প্রতিবেশী জানালেন, তিনি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মারা গেছেন। এই কথার সমর্থনে আমরা একটি শোক সংবাদ খুঁজে পেলাম।
একজন ভোটার তার ব্যালট পেপার ডাকযোগে আগেভাগে পাঠিয়ে দেয়ার পর নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিনের আগেই যদি মারা যান, মিশিগানের আইন অনুযায়ী সেই ভোট তখন বাতিল হয়ে যাবে।
তবে তার ব্যালটটি গোনায় ধরা হয়েছিল কিনা সেটা আমরা যাচাই করতে পারিনি।যাদের সঙ্গে আমরা ফোনে যোগাযোগ করতে পারিনি তাদের বেলায় আমরা অন্য উপায়ে যাচাই করার চেষ্টা করেছি তারা আসলে বেঁচে আছেন কিনা।
এর মধ্যে আছে রাজ্য সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পাবলিক রেকর্ডস যাচাই করা বা তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড খুঁজে দেখা।
একজন নারী ২০০৬ সালে মারা গেছেন বলে দাবি করা হচ্ছিল ‘মৃত ভোটারদের’ তালিকায়। কিন্তু আমরা দেখলাম একটি কোম্পানির বার্ষিক বিবরণীতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতেও তার স্বাক্ষর আছে।
আমাদের ৩১ জনের তালিকায় অন্য দুজন পুরুষ বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছেন বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু তাদের নামে ভোট দেয়া হয়েছে। ভোটিং ডাটাবেজ অনুযায়ী তাদের পোস্ট কোড এবং জন্মতারিখ সঠিক।
কিন্তু আমরা দেখলাম এই দু’জন আসলে এমন দুজন লোক, যাদের নাম হুবহু তাদের বাবার নামে এবং এরা তাদের প্রয়াত বাবার একই ঠিকানায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত।
তবে এই দুটি ক্ষেত্রেই আসলে তাদের মৃত পিতার নামে ব্যালট পেপার পাঠানো হয়েছিল।স্থানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তারা আমাদের বলেছেন যে, এই দুটি ভোটের একটি গণনায় ধরা হয়েছে। তবে এরকম কোনও রেকর্ড নেই যে ছেলেটি ভোট দিয়েছে।
অন্য ঘটনাটির বেলায় আসলে ছেলেটি ভোট দিয়েছে। কিন্তু এই ভোটটা রেকর্ড করা হয়েছে তার বাবার নামে। এটা হয়েছিল ভুলে।
‘এটা আসলে একটা সহজ পরিসংখ্যানের ব্যাপার’
দশ হাজার লোকের তালিকা থেকে আমরা মাত্র ৩১ জনের নাম বাছাই করেছিলাম। কিন্তু আমাদের অনুসন্ধানে এটা স্পষ্টতই বেরিয়ে এসেছে যে ট্রাম্পের সমর্থকরা যে তালিকাটি শেয়ার করেছেন সেটিতে অনেক ত্রুটি আছে।
আমাদের অনুসন্ধানে এটা পরিষ্কার আমরা যে ৩১ জনের ঘটনা যাচাই করে দেখেছি, তার প্রত্যেকটিতেই মিশিগানের প্রকৃত ভোটারদের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য জায়গায় মারা যাওয়া একই নামে, একই বছর একই মাসে জন্ম নেয়া লোকের তথ্যের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল তাদের একই লোক বলে দেখানো।রফেসর জাস্টিন লেভিট গণতান্ত্রিক আইন বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ।
“যদি কেবল নাম আর জন্মতারিখের ভিত্তিতে এই দুটি তালিকা মেলানো হয়, মিশিগানের মতো একটি রাজ্যে আপনি নিশ্চিতভাবেই কিছু ভুয়া মিল খুঁজে পাবেন।”
এই সমস্যাটাকে বলা হয় ‘দ্য বার্থডে প্রবলেম।’ একটি ক্লাসে একই নামের দুই জন শিক্ষার্থীর জন্মতারিখও যখন একই দিনে হয়, তখন এরকম একটা সমস্যা আমরা দেখি।
কাজেই মিশিগানের লক্ষ লক্ষ ভোটারের তালিকাকে যদি আপনি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সব মৃত মানুষের ডেটাবেজের সঙ্গে মেলান, তখন আপনি নিশ্চিতভাবেই অনেক মিল খুঁজে পাবেন। বিশেষ করে ভোটার তালিকার তথ্যভাণ্ডারে যখন কোন মানুষের জন্ম-মাসটাই শুধু দেয়া আছে, জন্ম তারিখের উল্লেখ থাকে না।
“এটা আসলে একটা পরিসংখ্যানগত ব্যাপার। আপনি যদি লক্ষ লক্ষ মানুষের রেকর্ড লক্ষ লক্ষ অন্য মানুষের রেকর্ডের সঙ্গে মেলান, আপনি বিরাট সংখ্যায় অনেক ভুয়া মিল খুঁজে পাবেন। আমরা এর আগেও এটা দেখেছি”, বলছেন জাস্টিন লেভিট।
তবে মারিয়া আরেডোনডো তার ভোট নিরাপদে ঠিকমতোই দিয়েছেন। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেনের নতুন প্রশাসনের অপেক্ষায় আছেন।
“ওবামার অধীনে তিনি একজন খুব ভালো ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমি খুবই খুশি। আমাদের কাঁধ থেকে একটা বোঝা নেমে গেছে।”