এক সময় মফস্বলে-গ্রামগঞ্জে মসজিদের ইমাম সাহেবদের সমাজে বিশেষ কদর ছিল। সহজ-সরল ধার্মিক ইমাম সাহেবদের অনেকেরই হয়তো গভীরভাবে ইসলাম ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নের সুযোগ ছিল না। আরবি পড়তে পারলেও আরবি ভাষার ওপর তেমন দক্ষতা ছিল না। কিন্তু ইসলামের নামে এমন কোনো বিপ্লবী উত্তেজনা তারা ছড়াতেন না যে, তাতে সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতো। সমাজে তারা নির্বিবাদী কল্যাণকামী মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
যেমন এগারো শতকের মাঝপর্ব থেকে এদেশে আসা সুফিরা মানুষের মনে শ্রদ্ধার আসন পেয়েছিলেন। তারা আল্লাহ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা প্রচার করে ব্রাহ্মণ শাসকদের দ্বারা নিপীড়িত শূদ্র হিন্দুর মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। আজকে যে এদেশে বৃহত্তর মুসলমান সমাজ, তা গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন এসব নির্বিবাদী সুফি সাধক। কোনো রাজনৈতিক লাভালাভের চিন্তা মাথায় নেয়া জেহাদি মোল্লাদের দ্বারা এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
১৯৭৫-এর পটপরিবর্তন সমাজ ও রাজনীতিতে নষ্ট প্রভাব ফেলতে থাকে। বিশেষ করে একশ্রেণির মোল্লা শক্তিশালী হতে থাকে, যারা নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি এনে এক ধরনের নৈরাজ্য তৈরি করে সুবিধার ফসল ঘরে তুলতে চেয়েছে। আমাদের মূলধারার ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এই মোল্লাতন্ত্রকে মই হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।
এভাবে ধর্মনেতাদের একটি অংশ সাধারণ মুসলমানের শ্রদ্ধার জায়গা থেকে সরে যেতে থাকেন। একদল মাদ্রাসার ছাত্র-অনুসারী পরিবেষ্টিত থেকে মনে করেন, এটিই বোধহয় এ দেশের সতের কোটি মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী দলটি হত্যাকারী আর ধর্ষণকারীদের দোসর হয়ে মানুষের আস্থার জায়গা থেকে সরে গিয়েছিল। পরে সময়ের সুবিধায় ছাত্রশিবির নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক তরুণদের নিয়ে বড় দল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
যাদের হাতে তুলে দেয়া হয় মারণাস্ত্র। এ ছাত্রশক্তি নিয়ে জামায়াত নিজেকে শক্তিশালী ভাবতে থাকে। কিন্তু জামায়াত মানতে চায়নি ঐতিহাসিকভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করা এদেশের মাটিতে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করবে না। তাই পাকিস্তান পর্ব থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্ব পর্যন্ত সময়কালে সব নির্বাচনেই জামায়াত সুবিধা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য স্বর্ণলতার মতো বিএনপির গায়েই জড়িয়েছে বারবার।
আজ আবার পরিণতির কথা না ভেবে বা ইতিহাসকে অস্বীকার করে জামায়াতের বি-টিমের মতো কয়েকটি উগ্রবাদী ইসলামী নামধারী দল মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। ধর্মগ্রন্থের উদার শিক্ষাকে আড়াল করে মনগড়া ব্যাখ্যায় নৈরাজ্য তৈরি করছে। শেষ পর্যন্ত হঠাৎ করে এ বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা, ভাস্কর্য স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করে দেশজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এসব দেখে সাধারণ মুসলমান, যারা ইসলামী দর্শনকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রাখে না, ধর্মের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে সরল শান্তিময় জীবনাচরণ করতে চায়, ইসলামকে শান্তিবাদী ধর্ম হিসেবে মানে, তারা চায় এসব জেহাদি ইসলামী নেতার কাছে সরল কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পেতে।
এ প্রশ্নটি তো তাদের মাথায় আসতেই পারে যে, বিশ্বমানচিত্রে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বড় কিছু নয়। খুব কম বাংলাদেশি আলেমের বিশ্বপরিচিতি রয়েছে বা তারা বৈশ্বিকভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে আসছেন। অথচ পৃথিবীর বড় বড় ইসলামী রাষ্ট্রের ধর্মীয় নেতারা ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য বুঝতে পারলেন সহজেই। তাহলে একমাত্র বাংলাদেশের কতিপয় আলেমগোষ্ঠী ভাস্কর্য আর মূর্তিকে এক করে ফেললেন কেন?
এসবে সাধারণ মানুষকে কি তারা বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন? নাকি তাদের চিন্তায় কোনো ভুল আছে? মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের তাৎপর্যগত গভীরতা কি তারা ব্যাখ্যা করতে পারেন না? নাকি তারা জ্ঞানপাপী? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে কিছুসংখ্যক আলেম পরিচয়ধারী মানুষের ধর্ম ব্যাখ্যায় বিশ্বাস স্থাপন করা কঠিন।
বিশেষ করে তারা যখন টেলিভিশনে দেখছেন সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান সব মুসলিম দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থানে সৌন্দর্য ও জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে নানা ভাস্কর্য এবং জাতীয় নায়কদের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্ন, অনেকদিন থেকেই তো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা শহরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে। এতদিন এ আলেমদের মনে হয়নি কেন যে, এসব ভাস্কর্য ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়। এসব ভাস্কর্য অপসারণের জন্য দাবিও তোলেনি- চোরাগোপ্তা হামলায় ভাংচুরও করেনি। আজ যখন বঙ্গবন্ধুর বড় অবয়বের ভাস্কর্য বসানোর কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে, তখনেই একে বন্ধ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছেন।
তাহলে তো সরল মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠতেই পারে ভয়টা কি তবে বঙ্গবন্ধুর বিশালত্বকে? এ ভীতি তো থাকতে পারে শুধু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানুষের। এ ধারার মানুষতো বিশ্বময় যুগ যুগ ধরে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে নিজেদের লাভের জায়গাটি পাকাপোক্ত করতে চেয়েছে।
ইসলাম ধর্মের স্বঘোষিত রক্ষাকারীরা এত কষ্টে ফ্যাসাদ তৈরির উপাদান খুঁজে বেড়াচ্ছেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। অথচ ধর্মীয় নির্দেশ পালনে চলমান ছোট-বড় অনেক বিভ্রান্তি মেটাতে তো কখনও ভূমিকা রাখলেন না। এই যে জুমার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নামাজে খুতবা পাঠের মতো একটি ওয়াজিব কাজ সহিভাবে এদেশে পালিত হচ্ছে কিনা এর উত্তর কেন পাচ্ছি না। সাধারণত ইমাম সাহেবরা খুতবা পাঠের আগে একটি বয়ান দেন। তারপর আজান হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক খুতবা একটি ছাপা বই থেকে অথবা মুখস্থ থাকলে আরবিতে পড়ে বা বলে যান; যা আরবি না জানা থাকায় এক ভাগ মুসল্লিও হয়তো বুঝতে পারেন না।
খুতবার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘বক্তৃতা’। আসলে নবীজির সময় থেকেই সপ্তাহের এ বড় জমায়েতে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ধর্মের আলোকে বিশ্লেষণ করা হতো। এ বক্তৃতাই খুতবা। মুসল্লিদের বোধগম্য ভাষাতেই তা করার কথা। কারণ মুসল্লি যদি বুঝতে না পারল তবে সে বক্তৃতার অর্থ কী! আমি ভারতে অনেক মসজিদে দেখেছি ইমাম সাহেব সমসাময়িক বিষয় নিয়ে উর্দুতে বয়ান করছেন। আমাকে এক অধ্যাপক জানালেন চীনে চীনা ভাষায় খুতবার বক্তৃতা দিতে দেখেছেন। আমি শুনেছি পূর্ব লন্ডনের কেন্দ্রীয় মসজিদে মাসে একবার খ্যাতিমান কোনো আলেমকে এনে জুমা পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।
আমি গত বছর তাদের খুতবা বোঝার জন্য লন্ডন সফরে শুক্রবারটা রেখেছিলাম। এ কেন্দ্রীয় মসজিদে আগে আগে গিয়ে সামনের কাতারে বসেছি। সেদিন এসেছিলেন সৌদি আরবের একজন ইমাম। তিনি মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত। মসজিদের প্রতি তলায় বয়ান শোনার জন্য বড় বড় স্ক্রিন রয়েছে। ইশারা ভাষায় তরজমার ব্যবস্থা ছিল। লন্ডনে বলে ইমাম সাহেব ইংরেজিতে বক্তৃতা করলেন। তার বক্তব্যের বিষয় ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতা।
মাঝে মাঝে দু-একটি কোরআনের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন মাত্র। মধ্যযুগের বাংলায় মুসলিম সুলতানরা যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন তখন এর জানান দিতেন নিজ নাম-উপাধি যুক্ত করে মুদ্রা উৎকীর্ণ করে আর খুতবার বক্তৃতায়। ইসলামে তো সব বিষয়ে সহজ বিকল্প রাখা হয়েছে। আমাদের ইসলাম হেফাজতকারী শ্রদ্ধেয় আলেমরা কি সহজ বিকল্প হিসেবে ছাপার অক্ষরে লেখা আরবিতে কতগুলো তৈরি বক্তৃতাই পড়ে যাবেন? সাধারণ মুসলমানকে কোনো কিছু না বুঝে ধৈর্য ধরে শুনিয়ে সওয়াবের পথটিই শুধু দেখাবেন? তাহলে খুতবা পড়ার উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হবে? কই এসব জরুরি বিষয় নিয়ে তো প্রতিবাদী আলেমদের দায়িত্ব পালন করতে দেখি না।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রশ্ন যখন বড় হয়ে পড়ে, তখন এভাবেই বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুরা ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ ধর্মাচারীদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। মধ্যযুগের ইউরোপে পোপরা একবার ‘ইনডালজেন্স’ চালু করেছিলেন। অর্থাৎ পাপমোচনের সার্টিফিকেট। সাধারণ খ্রিস্টান পাপ করে রোববার চার্চে গিয়ে পাদ্রির কাছে দোষ স্বীকার করত। আগে পাদ্রি দোষমোচনের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন। ক্রমে লোভ বেড়ে যায়। এবার পাপের ভয়াবহতা অনুযায়ী অর্থ জরিমানা দিতে হতো। অর্থপ্রাপ্তির স্বীকৃতি হিসেবে সার্টিফিকেট বা ইনডালজেন্স দিতেন পাদ্রিরা।
মৃত্যুর পর কফিনে দিতে হতো এ সার্টিফিকেট। যেন অর্থ পরিশোধের সনদ দেখে ঈশ্বর স্বর্গে পাঠিয়ে দেন। আগে ইউরোপের রাজ্যগুলোর রাজা কে হবেন তা রোমান পোপই নির্ধারণ করতেন। ৯ শতকে গল অর্থাৎ ফ্রান্সের রাজা শার্লামেন পোপের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেন। পরবর্তী সময়ে এ ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য পোপরা ধর্মের নাম ভাঙিয়ে ক্রুসেড বাধিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে অসংখ্য মানুষ ও হাজার হাজার শিশুর প্রাণহানির কারণ হয়েছিলেন এসব ধর্ম নেতা।
এগারো শতকের মাঝ পর্বে বাংলার ব্রাহ্মণ সেন রাজারা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বর্ণপ্রথা উসকে দিয়েছিলেন। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে সাধারণ হিন্দুকে শূদ্র পরিচয়ে নিষ্পেষণ করতে থাকেন। শূদ্রের জন্য ধর্মগ্রন্থ পড়া নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কারণ একটাই, ছিল প্রকৃত ধর্ম জেনে গেলে মানুষকে যা কিছু খুশি বোঝানো যাবে না।
এ একুশ শতকে এসেও আমাদের দেশে আলেম নামধারী কিছুসংখ্যক মানুষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে প্রাচীন যুগের ব্রাহ্মণ বা মধ্যযুগের পোপদের মতো আচরণ করছেন। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য, ইতিহাসের শিক্ষা যদি সঠিক হয়, তবে দীর্ঘকাল অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য লালন করা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করাটা সহজ হবে না। এ দেশের সাধারণ মানুষ এখন আর অতটা ধর্ম-মূর্খ নন। শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ধর্মচর্চার সুযোগ অনেক বেড়েছে। ধর্মের নামে যা কিছু তা বলার দিন কিন্তু ছোট হয়ে আসছে।
ধর্ম নিয়ে সাধারণ মানুষের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে যারা তালেবে এলমদের দিয়ে নৈরাজ্য করতে যাবেন, তাদের তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়