বাংলাদেশে এখন বেশুমার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নয়, অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরে লুকিয়ে থাকা অসত্ ব্যবসায়ী আর লোভী মানুষদের সংঘবদ্ধতা। সিন্ডিকেট আছে পেঁয়াজের বাজারে, চালের কলে, ফলমূলের আড়তে, আমদানি-রপ্তানিতে, সড়ক পরিবহনে, এমনকি মিছিল কিংবা আন্দোলন আয়োজনে। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সিন্ডিকেট নামক ‘কার্টেল’ আগেও ছিল এবং থাকবেও হয়তো বর্তমান-ভবিষ্যতে যতদিন পর্যন্ত মানুষের অবয়বে হায়েনারা বসবাস করবে এ জগত্-সংসারে। মানুষের এই গ্রহে বহু বহুবার বহু দেশে-অঞ্চলে অতীতে আকাল দেখা দিয়েছে, দুর্ভিক্ষে অগণিত মানবসন্তান মারা গিয়েছে, খাদ্যের সংকটকে পুঁজি করে তীব্র আন্দোলনে সাম্রাজ্যের বা সরকারের পতন হয়েছে, এমনকি যুদ্ধবিগ্রহও সংঘটিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, বেশির ভাগ দুর্ভিক্ষের কারণ মানুষ নিজেই—সজ্জন মানুষ নয়, লোভী আর মানবতাবিবর্জিত মানুষ। দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যসামগ্রীর মনুষ্যসৃষ্ট আকাল শুরু করা হয় একটু একটু করে, ধীরে ধীরে একটি একটি পণ্য দিয়ে, যাতে সাধারণ মানুষ বিষয়টি বুঝতে না পারে, এমনকি প্রশাসনের লোকেরাও যেন ‘আঁধারের’ মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। অর্থনীতিকে এলোমেলো করে দিয়ে তারপর সেই লোভী মানুষেরা শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সংকট সৃষ্টি (চাল, ডাল, লবণ, চিনি, ফলমূল ইত্যাদি)। এমন ধারায় দুর্ভিক্ষ হয়েছে হাজার হাজার বছর আগেও, যার বিবরণ পাওয়া যায় বাইবেলে। বিংশ শতাব্দীতেও অনেক দুর্ভিক্ষ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে। চীনে ১৯৫৯-৬১ সালের দুর্ভিক্ষ প্রায় ৩ কোটি লোকের জীবন হরণ করেছে। ইথিওপিয়ায় ১৯৮৪-৮৫ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তাতে ১০ কোটি লোকের মৃত্যু হয়। উত্তর কোরিয়ায় ১৯৯৬-৯৯ সালে সংঘটিত দুর্ভিক্ষ আড়াই কোটি লোকের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এর বাইরেও অগণিত মানুষ মারা গিয়েছে দুর্ভিক্ষজনিত পুষ্টিহীনতায় আর রোগশোকে। মধ্যযুগে ইউরোপ অঞ্চলে সংঘটিত বহু দুর্ভিক্ষের মূল কারণ সামন্তবাদী প্রথা, জমিদারি অনাচার, জোতদারদের কারসাজি। মধ্যযুগে শুধু ফ্রান্সেই ৭৫ বারের বেশি দুর্ভিক্ষ হয়েছে; বহুবার হয়েছে ব্রিটেনে। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ায় প্রায় ৫ লাখ লোক মারা যায় দুর্ভিক্ষে। ১৮৪৫-৪৯ সালে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময়ে আয়ারল্যান্ডে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে আলুর গুদামে (আলু ওদের প্রধান খাদ্য ছিল) লুটপাট পর্যন্ত করেছে। ১৫০০ থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত সময়ে পূর্ব ইউরোপে যত দুর্ভিক্ষ হয়, তার সবগুলো ছিল মনুষ্যসৃষ্ট। খাদ্যের উপাদন আর বিতরণে বাধা সৃষ্টি, খাদ্যসামগ্রী বিনষ্ট করা, সাগরে ফেলে দেওয়া; গম, ধান, আলুর ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ফসল বিনষ্ট করা আর খাদ্যদ্রব্য মাটির তলায় লুকিয়ে রাখা ইত্যাদি জনগর্হিত কমকাণ্ড ছিল দুর্ভিক্ষের মূল কারণ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশেও আমরা এমনতরো কিছু ঘটনা লক্ষ করেছি, যার কারণে ১৯৭৪ সালে খাদ্যসামগ্রী মজুত থাকা সত্ত্বেও সদ্য স্বাধীন দেশটিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।
বাংলাদেশে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয়নি, হয়েছিল খাদ্যসামগ্রীর সুষম বণ্টনের অভাবে। বিদেশ থেকে প্রচুর খাদ্য আমদানি করেছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার; কিন্তু চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদি চলে গিয়েছিল মাটির তলার গুদামে। তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম সংকট। যারা কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছিল, তারা করেছিল খুবই চতুরতার সঙ্গে, যাতে জনসাধারণ বুঝতেই না পারে কোথা থেকে কী হচ্ছে। এমন একটা সময়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হলো, যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠিত করার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের নবগঠিত সরকারকে দেশবাসীর কাছে অজনপ্রিয় ও ব্যর্থ প্রতিপন্ন করা। মার্চের দিকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল দুর্ভিক্ষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষের কথা বাবা-চাচার মুখে শুনেছি, বইপত্রেও পড়েছি। তারও আগে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত দুর্ভিক্ষ ছিল পুরো বাংলায় বিধ্বংসী আকাল। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের কালজয়ী লেখা থেকে জানতে পারি, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষও সংঘটিত হয়েছিল খাদ্যের অভাবে নয়, কতিপয় দেশপ্রেমহীন অর্থলোভী মানুষের মানবতাবিবর্জিত কর্মকাণ্ডের কারণে। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের খলনায়কেরা ছিল একই ধরনের মনোবৃত্তিসম্পন্ন। লোভী, অর্থগৃধ্নু। এরা ছিল মূলত স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি চক্র। ষড়যন্ত্র করে ঘটিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। অতি সংগোপনে পরিচালিত পরিকল্পিত সরকারবিরোধী এই চক্রান্তে জড়িত ছিল অনেক রাঘববোয়াল, যা পরে আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধী উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ পাকিস্তানপন্থি আরো অনেকে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ঘটানোর জন্য খাদ্যসামগ্রী মজুত করে, কখনো কখনো রাতের আঁধারে নদীতে ফেলে দিয়ে খাদ্যের সংকট তৈরি করে। দেশের মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তোলার জন্য এই দুর্ভিক্ষ ছিল একটি বিশাল অস্ত্র।
আবারও শুরু হয়েছে চুয়াত্তরের মতো চক্রান্ত, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ২০১৯ সালের শেষ দিকে এসে। ভোলার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর শুরু ‘পেঁয়াজ-সন্ত্রাস’। দুই মাস ধরে বাড়াতে বাড়াতে নভেম্বরের মাঝামাঝি এসে প্রতি কেজি ৩০ টাকায় কেনা পেঁয়াজের দাম উঠিয়ে দিয়েছে শহরে ২৫০ এবং গ্রামাঞ্চলে ২৮০ টাকায়। মশলাপ্রিয় বাঙালিদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের তুঙ্গে থাকা চহিদাকে পুঁজি করে জেনেবুঝে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামিয়ে আনার এক সুদূরপ্রসারি চক্রান্ত এই পেঁয়াজ-সন্ত্রাস। এখানে ডিমান্ড-সাপ্লাই সূত্র কাজ করছে না; কাজ করছে চক্রান্ত। দেশের ভেতরেও প্রচুর পেঁয়াজ মজুত আছে। বাজারে দোকানে দোকানে পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পাইকারি মোকামে কেন তেলেসমাতি ঘটছে? ওখানে কারা সক্রিয়? খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা কেন বস্তা বস্তা পেঁয়াজ পচিয়ে নদীতে ফেলে দিচ্ছে? কুমিল্লার গৌরীপুরে সেতুর নিচে কারা বস্তা বস্তা পেঁয়াজ ফেলে দিয়ে সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল? এরাও পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের সদস্য। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে পচানো পেঁয়াজ ভাগাড়ে আর রাস্তায় ক্রেতাদের পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে হুড়াহুড়ি আর মারামারি। চুয়াত্তরের কুশীলবদেরই এরা বংশধর, যারা পেঁয়াজকাণ্ড ঘটিয়েছে!
কয়েক দিন ধরে হঠাত্ই শুরু হয়েছে অন্য একটি ষড়যন্ত্র; এটি হলো ‘চাল নিয়ে চালবাজি’। ‘বুলবুল’-এর পর থেকেই ঝড়বৃষ্টির দোহাই দিয়ে শুরু করেছে চালের দাম বাড়ানোর খেলা। নতুন ধান ওঠার মৌসুম শুরু হবে; কয়েক দিন আগেই বিনা কারণে অযৌক্তিকভাবে হঠাত্ করেই চালকলের মালিকরা নেপথ্যে সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিয়েছে চালের দাম। একটি টিভির খবরে দেখলাম, মিল মালিকরা ধান গুদামজাত করে রেখে দিয়েছে আর এ কারণে চালের দাম বাড়তির দিকে। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘সর্বকালের সর্বোচ্চ চাল মজুত রয়েছে’। কৃষি বিভাগও দাবি করছে, কুষ্টিয়াসহ সব চালের মিলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান আর চাল মজুত থাকা সত্ত্বেও মূল্য বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, হঠাত্ করে চালের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কোনো কিছু থাকতে পারে না। ব্যবসায়ীরা তো কেনা দামের রসিদ পর্যন্ত বাজার তদারককারীদের দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করছে। এর পেছনে কারণ কী? সরকারের কোনো উদ্যোগের প্রতি তারা কোনো প্রকার সম্মানই দেখাচ্ছে না, সহযোগিতা তো দূরের কথা। ফেব্রুয়ারি মাসে যে পেঁয়াজ কিনতে লাগত ২০ টাকা প্রতি কেজি, তা ২৫০ টাকার ওপরে উঠে গেল কেন? মানুষজন গ্রামে-গঞ্জে-শহরে বেশ ক্ষুব্ধ। প্রতিটি ঘরে গিন্নিরা ক্ষুব্ধ। সারা বাংলাদেশে কত কোটি গিন্নি আছে তার হিসাব আমার জানা নেই। তবে তা যে বিশাল একটা অঙ্ক হবে (কয়েক কোটির ঘরে তো অবশ্যই) তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়। এরাই কিন্তু ভোটের বাজারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা না হলে বারবার সুযোগ বুঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে ষড়যন্ত্রকারীরা।
সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে ইরানে, মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে। বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন দিয়ে এতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যে দেশটি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সুযোগ পেলে ঘৃতাহুতি দেওয়ার লোকের অভাব এদেশেও হবে না; অন্য কোনো দেশকেও তারা কাজে লাগাতে পারে। দেশবাসী দেখেছে কীভাবে অতি সম্প্রতি ভোলায় ঘটানো হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা; রেলে একাধিক দুর্ঘটনা; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা। সবকিছু মিলিয়ে একাত্তর-পরবর্তী সময়কালে যেভাবে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হয়েছে, ঠিক প্রায় একইভাবে ওদেরই উত্তরসূরিরা এমন ক্ষেত্রগুলো বেছে নিচ্ছে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে সুযোগমতো যোগ দেবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যারা ধরা খেয়েছে তারা এবং তাদের শাগরেদরা। এদের স্বার্থ হানি হয়েছে; সুতরাং তারা চুপ করে বসে থাকবে, এমনটি আশা করার কোনো হেতু নেই। ভুলে গেলে চলবে না যে তারা সংগঠিত অপশক্তি। তারা সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন চায় না, ডেল্টা প্ল্যানের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যত্ চেহারা পালটে দেওয়ার পরিকল্পনা পছন্দ করে না। সাবধান হতে হবে এখনই। জাতি প্রত্যাশা করে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ভেদ করে এগিয়ে যাবে দৃপ্তপদে উন্নয়নের পথে, সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে থাকবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
n লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়