শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:১১ অপরাহ্ন

যেভাবে ঢাকা শহরে জমির দাম নির্ধারণ করে সরকার

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২১
  • ১৩৪ বার

সম্প্রতি রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় জমি কিনেছেন ইব্রাহিম মুন্সী। ওই জমির আশেপাশে আরো জমি পাওয়া গেলে সেটিও কিনতে আগ্রহী তিনি। বলেন, জমি কেনার উদ্দেশ্যে হচ্ছে সন্তানদের ভবিষ্যত নিরাপদ করা।

ইব্রাহিম মুন্সী বলেন, ভবিষ্যতে বাসস্থান তৈরি করা না হলেও জমিতে বিনিয়োগ লাভজনক। এছাড়া সময়ের সাথে সাথে জমির দামও বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরি পলিসি রিভিউ রিপোর্ট ২০২০-এর তথ্যও ইব্রাহিম মুন্সীর এই যুক্তিকে সমর্থন করে।

এই রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা শহরে জমির দাম বহুগুণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরি পলিসি রিভিউ রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে গুলশান এলাকার এক কাঠা জমির দাম ছিল ২৫ হাজার টাকা। ১৯৯০ সালে এই দাম লাখের ঘরে চলে যায়। আর এর ৩০ বছর পর অর্থাৎ ২০২০ সাল নাগাদ এই এলাকার জমির দাম কাঠা প্রতি এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি টাকায়।

শুধু গুলশান নয়, ঢাকার সব এলাকাতেই জমির দাম আকাশচুম্বী হয়েছে গত ৪৫ বছরের ব্যবধানে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বারিধারা এলাকায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বারিধারা এলাকায় এক কাঠা জমির বাজারদর এখন ছয় কোটি টাকা।

তবে মিরপুর, উত্তরা, বাড্ডা, বাসাবো, শ্যামলী, গেণ্ডারিয়া এলাকায় জমির দর কাঠা প্রতি ১০ লাখের নিচে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই তালিকায়।

রিহ্যাবের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দশকে ঢাকায় জমির দাম গড়ে ৩০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

জমির দাম কিভাবে নির্ধারিত হয়?

ক্রেতা এবং বিক্রেতার দর কষাকষি ছাড়াও ঢাকা শহরে সরকারিভাবে জমির সর্বনিম্ন বাজার দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে জমির দাম নির্ধারণে সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারদর বিধিমালা ২০১০ অনুসরণ করা হয়।

ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার বলেন, ‘২০১০ সালের আমাদের একটা বিধিমালা রয়েছে যেটা আমরা অনুসরণ করে থাকি। তবে সময়ে সময়ে এটা আবার সংশোধনও করা হয়।’

এই বিধিমালা কার্যকর হওয়ার পর প্রথম দিকে প্রতি বছর জমির দাম সংশোধন করে হালনাগাদ করা হতো।

তবে ২০১৫ সালে এ বিধিমালাটি সংশোধন করার পর এখন প্রতি দুই বছর পর পর জমির দাম হালনাগাদ করা হয় বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, জমির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো একটি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে শুরু করে পরের বছরের ৩১শে অক্টোবর অর্থাৎ ২২ মাস পর্যন্ত একটি হিসাব করা হয়।

সাবিকুন নাহার বলেন, জমির দাম সাধারণত সুনির্দিষ্ট একটা মৌজার একটা শ্রেণীর জমির দামকে গড় করে বাজার দর নির্ধারণ করা হয়।

মৌজা হচ্ছে, রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে ছোট একক। প্রতিটি থানা এলাকাকে অনেকগুলো এককে বিভক্ত করে প্রত্যেকটি একককে ক্রমিক নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রতি একককে একেকটি মৌজা বলে। একটি মৌজায় এক বা একাধিক গ্রাম বা পাড়া বা মহল্লা থাকতে পারে।

ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার বলেন, মৌজা ও শ্রেণী অনুযায়ী জানুয়ারির এক তারিখ থেকে ওই পরের বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যত জমি বিক্রি হয় তার গড় করে ওই শ্রেণীর সব জমির বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

এ বিষয়ে জমির দাম নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা নিবন্ধন অধিদফতরের সহকারী মহা-পরিদর্শক নৃপেন্দ্র নাথ সিকদার বলেন, ‘যদি একটি মৌজায় পাঁচটি দলিল রেজিস্ট্রেশন হয়ে থাকে তাহলে ওই দলিলগুলোর আওতায় কতটুকু জমি হস্তান্তর হলো এবং তাদের মূল্য কত-সেগুলোর একটা গড়কে বাজারমূল্য হিসেবে ধরা হয়।’

‘এক্ষেত্রে মোট দামকে মোট জমির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করা হলে ডেসিমেল প্রতি একটা মূল্য বের হয় এবং সেটাকেই বাজার মূল্য হিসেবে ধরা হয়। তবে কেউ এটার চেয়ে কম মূল্য লিখতে পারবে না, বেশি লিখলে কোন আপত্তি নেই,’ বলেন তিনি।

তবে সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বাজার দর অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত মূল্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। এ বিষয়টি এক পরিপত্রে উল্লেখও করে নিবন্ধন অধিদফতর।

এতে বলা হয়, অধিকাংশ মৌজায় সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত মূল্য বিগত কয়েক বছরে প্রকৃত মূল্যের তুলনায় বেড়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বাজার দর প্রকৃত বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক কম।

বাজারমূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি

সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা ২০১০ অনুযায়ী, সরকারি মালিকানাধীন কোনো সম্পত্তির বাজারমূল্য সরকার অথবা প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির বাজার মূল্যও ওই সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কিংবা নিলামের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির বাজারমূল্য নির্ধারণ করে একটি কমিটি। এই কমিটিতে থাকেন একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা রেজিস্ট্রার, সহকারী কমিশনার ভূমি এবং একজন সাব-রেজিস্ট্রার।

এই কমিটির সদস্য সচিব প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সাব-রেজিস্ট্রি এলাকায় রেজিস্ট্রিকৃত সব সাব-কবলা দলিলের মূল্যের উপর মৌজার শ্রেণীভিত্তিক গড় মূল্যের একটি তালিকা তৈরি করে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে জমা দিয়ে থাকেন।

পরে কমিটির অন্য সদস্যরা এই তালিকার মূল্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাজারমূল্য হালনাগাদ করে।

এই বিধিমালা অনুযায়ী, ব্যক্তি মালিকানাধীন কোন জমির উপরে স্থাপিত কোনো স্থাপনা, ইমারত, ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তরের দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে হস্তান্তরকারী যে মূল্য দিবেন সেটিকেই বাজার মূল্য হিসেবে ধরতে হবে। তবে এই মূল্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের জন্য ১৫০০ টাকার কম হবে না।

কোন কোন বিষয় প্রভাব ফেলে?
সরকারিভাবে জমির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূলত যেসব বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এগুলো হচ্ছে-

১. জমির অবস্থান :

ঢাকা শহরে জমির দাম নির্ধারিত হয় ওই জমির অবস্থান কোথায় সেটার উপর ভিত্তি করে।

নিবন্ধন অধিদফতরের সহকারী মহা-পরিদর্শক নৃপেন্দ্র নাথ সিকদার বলেন, একই শহরের বিভিন্ন এলাকায় নানা কারণে জমির দাম ভিন্ন হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি বড় বিষয় হচ্ছে জমির অবস্থান।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গুলশানের জমির তুলনায় উত্তরা এলাকার জমির দাম আলাদা।

‘মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় জমির যে দাম হবে, সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে সরে গিয়ে বিলের ভিতর জমির তো সেই একই দাম হবে না,’ বলেন তিনি।

২. জমির শ্রেণী :

জমির শ্রেণী হলো মূলত জমির ধরণ। যেমন, বাড়ি করার জমি, বাণিজ্যিক এলাকার জমি বা কৃষিকাজের জমি। এগুলো একেকটা শ্রেণী।

এই শ্রেণী অনুযায়ী জমির দামও ভিন্ন হয়ে থাকে। বাড়ি করার জমির তুলনায় কৃষি জমির দাম ভিন্ন হয়।

আবার একই শ্রেণীর আলাদা আলাদা জমির দামও আলাদা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে ২০২০ সালে একটি পরিপত্রের মাধ্যমে নিবন্ধন অধিদফতর থেকে জানানো হয় যে, কোন মৌজার কোন অংশে বাজার, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ বা কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকলে তার আশপাশের জমির মূল্য একই মৌজার একই শ্রেণীভুক্ত অন্য জমির তুলনায় বেশি হয়।

কিন্তু বর্তমানে যে পদ্ধতিতে জমির বাজারদর নির্ধারণ করা হয়ে তাতে সব জমির দাম একই হয়। এই সমস্যাটি সমাধানে মৌজাসমূহকে গুচ্ছ বা ক্লাস্টারে ভাগ করে সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের কথা জানায় নিবন্ধন অধিদফতর।

এছাড়া রাজধানীতে কোনো এলাকায় নাগরিক সুবিধা কতটুকু সেটার উপর ভিত্তি করেও অনেক সময় জমির দামে তারতম্য হয়।

তবে নগর পরিকল্পনাবিদেরা মনে করেন যে, জমির দাম নির্ধারণের আরো কয়েকটি বিষয় রয়েছে যেগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।

৩. মাটির গঠন :

নগরবিদ এবং বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, কোনো একটি জমির গঠন কেমন অর্থাৎ সেটি উঁচু নাকি নিচু সেটির উপরও জমির দাম কত হবে সেটা নির্ভর করে।

তিনি বলেন, যেসব জমিতে ভবন তুলতে হলে মাটি ভরাট করতে হয় কিংবা নদী, খাল-বিল বা জলাভূমি ভরাট করে যেসব জমি তৈরি করা হয় সেগুলোর দাম তুলনামূলক কম হয়। কারণ এসব জমির উপর ভবন নির্মাণে একদিকে যেমন বেশি খরচ হয় অন্যদিকে তেমনি এসব ভবনে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি থাকে।

এছাড়া যেসব জমি ভৌগলিকভাবে কিছুটা উঁচু এলাকায় অবস্থিত সেগুলোর দাম বেশি থাকে। এই কারণেই গুলশান, বনানি, ধানমণ্ডি এলাকার জমির দাম বেশি কারণ এগুলো কিছুটা উঁচু এলাকায়(এলিভেটেড ল্যান্ড) অবস্থিত।

৪. দূরত্ব :

অধ্যাপক ইশরাত বলেন, শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে জমিটা কতদূরে অবস্থিত সেটির উপরও জমির দাম নির্ভর করে।

ঢাকার ক্ষেত্রে বলা হয়, মতিঝিল বা বাণিজ্যিক এলাকা থেকে জমিটা যত দূরে অবস্থিত হয় জমির দাম ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

৫. নাগরিক সুবিধা :

রাজধানীতে কোনো এলাকায় নাগরিক সুবিধা কতটুকু সেটার উপর ভিত্তি করেও অনেক সময় জমির দামে তারতম্য হয়।

অধ্যাপক ইশরাত বলেন, কোনো জমির পাশে রাস্তা কতটা প্রশস্ত সেটার উপরও দাম নির্ভর করে। রাস্তা যত বেশি প্রশস্ত হয় দাম তত বেশি হয়। এছাড়া জমির পাশে কোন লেক, খেলার মাঠ, হাসপাতাল, স্কুল আছে কিনা- সেসব বিষয়ও জমির দামের উপর প্রভাব ফেলে।

তবে রাজধানীর পুরনো এলাকা বা পুরনো ঢাকার জমির ক্ষেত্রে এসব যুক্তি কাজ করে না বলে জানান তিনি।

এই নগরপরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘পুরনো ঢাকায় জমির দাম এমনিতেই বেশি। এটার ক্ষেত্রে কোনো সূত্র কাজ করে না।’

এছাড়া স্ট্যাটাস বা সামাজিক সুনাম বা শ্রেণীবিভাগও দাম উঠানামার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com