শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:০৫ পূর্বাহ্ন

সন্তানদের ফিরে পেতে সেই জাপানি মায়ের আপিল

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১
  • ১৪০ বার

দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিজের জিম্মায় নিতে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন জাপানি মা নাকানো এরিকো। আজ রোববার আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আবেদন (সিএমপি) করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

এর আগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ইমরান শরীফ ও জাপানি নাগরিক ডা. এরিকো নাকানোর দুই শিশু কন্যাকে বাংলাদেশে তার বাবার জিম্মায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। চাইলে জাপানি মা ১০ দিন করে বছরে ৩০ দিন দেখা করতে এবং তাদের সঙ্গে একান্তে অবস্থান করতে পারবেন।

এ ছাড়া শুনানি শেষে তিনজনের মধ্যে সবার ছোট কন্যাকে জাপান থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাবা ইমরান শরীফের করা রিট সরাসরি খারিজ করে দেন আদালত। তবে তাদের মায়ের করা রিট চলবে।

গত ২১ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দুই শিশুকে নিয়ে দেওয়া রায়ে বলেন, যেহেতু মা জাপানি নাগরিক, সেখানে তার বসবাস ও কর্মস্থল সে কারণে তিনি তার সুবিধামত সময়ে বাংলাদেশে এসে শিশুদের সঙ্গে প্রতিবার কমপক্ষে ১০ দিন একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বছরে তিন বার বাংলাদেশে তার যাওয়া আসাসহ ১০ দিন অবস্থানের যাবতীয় খরচ শিশু দুটির বাবাকে বহন করত হবে। তবে এর চেয়ে অতিরিক্ত যাওয়া-আসা বা বাংলাদেশে অবস্থানের ক্ষেত্রে খরচ মা নিজে বহন করবেন।

এ ছাড়া বাবা মাসে কমপক্ষে দুই বার শিশু সন্তানদেরকে ভিডিও কলে মায়ের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবেন। আর গত কয়েক মাস বাংলাদেশে অবস্থান ও যাতায়াত বাবদ ওই মাকে ১০ লাখ টাকা সাত দিনের মধ্যে দিতে শিশুদের বাবার প্রতি নির্দেশ দেন আদালত। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট সমাজ সেবা কর্মকর্তাকে এই শিশুদের দেখভাল অব্যাহত রাখতে এবং প্রতি তিন মাস পর পর শিশুদের বিষয়ে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর প্রতিবেদন দিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেন।

অন্যদিকে জাপানে থাকা এদের আরেক মেয়েকে হাইকোর্টে হাজিরের নির্দেশনা চেয়ে ইমরান শরীফের করা রিটটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। আদেশে আদালত বলেন, রিটটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো পক্ষ কর্তৃক আদালতের আদেশ প্রতিপালিত না হলে বা অন্য কোনো আদেশের প্রয়োজনে তারা আদালতে আসতে পারবেন।

আদালত বলেছেন, যেহেতু মা জাপানি নাগরিক, সেখানে তার বসবাস ও কর্মস্থল, সে কারণে তিনি তার সুবিধামতো সময়ে বাংলাদেশে এসে শিশুদের সঙ্গে প্রতিবার কমপক্ষে ১০ দিন একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। এক্ষেত্রে বছরে তিন বার বাংলাদেশে তার যাওয়া আসাসহ ১০ দিন অবস্থানের যাবতীয় খরচ শিশু দুটির বাবাকে বহন করত হবে।

এরিকোর আইনজীবী শিশির মনিরের তথ্যমতে, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি নাগরিক ডা. এরিকো নাকানো (৪৬) ও বাংলাদেশি আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইনানুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। ১২ বছরের সংসারে তিনটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তারা হলো- জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) ও সানিয়া হেনা (৭)। এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। তিন মেয়ে টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের (এএসজেআই) শিক্ষার্থী ছিল।

সন্তানদের জিম্মা নিয়ে করা রিটের শুনানি শেষে রায়ের নির্ধারিত দিনে ২১ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

আদালতে ওইদিন ইমরান শরীফের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল ও ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। তাদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী ফেরজা পারভিন, কাজী মারুফুল আলম ও ফাইজা মেহরিন। এরিকো নাকানোর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

আদালতের রায়ের বিষয়ে ওইদিন ফাউজিয়া করিম ফিরোজ ও মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, মা দেখা-সাক্ষাৎ ও একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন। যেহেতু এরিকো নাকানো জাপানি নাগরিক এবং সেখানে কর্মরত, তাই তিনি প্রতি তিনমাস পরপর বাংলাদেশে এসে কমপক্ষে দশ দিন সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। আর বছরে তিনবার বাংলাদেশে যাওয়া-আসাসহ সব খরচ বাবা ইমরান শরীফকে বহন করতে হবে। তবে অতিরিক্ত সময় যাওয়া-আসা করলে তার খরচ মাকেই বহন করতে হবে। এ ছাড়া ইমরান শরীফ মাসে কমপক্ষে দুবার ছুটির দিন সন্তানদের সঙ্গে তাদের মাকে ভিডিওকলে কথা বলার সুযোগ করে দেবেন।

রায়ে আদালত আরও বলেন, বাংলাদেশে আসা-যাওয়া এবং থাকার খরচ বাবদ ইমরান শরীফ আগামী সাত দিনের মধ্যে এরিকো নাকানোকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে দেবেন। সমাজ সেবা অধিদপ্তরকে প্রতি তিনমাস পর পর হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। সাথে সাথে এসব বিষয়ে সমাজ সেবা অধিদপ্তরকে বিষয়টি তদারকি করতে বলা হয়েছে।

এর আগে, রায় ঘোষণার নির্ধারিত দিন গত ১৪ নভেম্বর জাপানি নাগরিক মা নাকানো এরিকোর কাছে থাকা সন্তানকে দেশে ফেরানো ও বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের কাছে থাকা দুই সন্তানকে মায়ের কাছে রাখা সংক্রান্ত রিটের রায় পিছিয়ে ২১ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট ভার্চুয়াল বেঞ্চ দিন ধার্য করেন।

ওই দম্পতির তৃতীয় সন্তানকে জাপান থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতে হাজির করার জন্য নির্দেশনা চেয়ে গত সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ইমরান শরীফের আইনজীবী। পরে মূল রিটের সঙ্গে ওই রিটের বিষয়েও শুনানি হবে বলে আদালত গত ৩০ সেপ্টেম্বর আদেশ দেন। সেই মোতাবেক নির্ধারিত দিনে গত ২১ অক্টোবর শুনানি হয়। শুনানিতে ইমরান শরীফের আইনজীবীদের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ অক্টোবর পরবর্তী দিন ধার্য করেন আদালত।

এর আগে দুই মেয়েকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে গত ১৯ আগস্ট রিট করেন জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো। এরপর জাপানি দুই শিশু এবং তাদের বাবা ইমরান শরীফকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে দুই শিশুকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন। ২২ আগস্ট দুই শিশুকে হেফাজতে নেয় সিআইডি। বিষয়টি ২৩ আগস্ট হাইকোর্টের নজরে আনেন তাদের বাবার আইনজীবী ফাওজিয়া করিম। পরে আদালত শিশুদের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উন্নত পরিবেশে রাখার নির্দেশ দেন। এ সময়ে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত জাপানি মা ও বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাংলাদেশি বাবা শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন বলে আদেশে বলা হয়।

গত ২৩ আগস্ট মায়ের সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকা দুই শিশুকে উন্নত বাসায় রাখার প্রস্তাব করেছিলেন তাদের বাবা ইমরান শরীফ। ৩১ আগস্ট হাইকোর্ট আদেশ দেন, বাবা-মাসহ রাজধানীর গুলশানের একটি বাসায় থাকবে জাপানি দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা। ৮ সেপ্টেম্বর আদেশ দেন দুই শিশুকে নিয়ে বেড়ানো বা মার্কেটে যাওয়ার জন্য বাইরে যেতে পারবেন মা নাকানো এরিকো।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মর্মে আদেশ দেন যে, রাজধানীর গুলশানের ফ্ল্যাটে দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনার সঙ্গে জাপানি নাগরিক মা নাকানো এরিকো রাতসহ ২৪ ঘণ্টা থাকবেন। বাবা ইমরান শরীফ শুধু দিনে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। এই সময়ে ওই ফ্ল্যাটের ভাড়া শিশুদের বাবা-মাকে সমানভাবে বহন করতে হবে।

দুই শিশুকন্যাকে ফিরে পেতে হাইকোর্টে শিশুদের হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে ঢাকায় এসে গত ১৯ আগস্ট রিট আবেদন করেন জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো, যিনি পেশায় চিকিৎসক। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই দিনই হাইকোর্টের একই বেঞ্চ দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট আদালতে হাজির করতে তাদের বাবা শরীফ ইমরান ও ফুফুকে নির্দেশ দেন।

চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরানের এরিকোর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ২১ জানুয়ারি ইমরান আমেরিকান স্কুল ইন জাপান কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। এতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর একদিন জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসস্টপ থেকে ইমরান তাদের অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।

গত ২৫ জানুয়ারি ইমরান শরীফ তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছ থেকে মেয়েদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে মেয়েদের নিজ জিম্মায় পেতে আদেশ চেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি মেয়েদের সঙ্গে এরিকোর সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে আদেশ দেন।

কিন্তু ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়েকে সাক্ষাতের সুযোগ দেন। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে’ ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিয়ে তিনি দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।

এরপর গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে তাদের মা এরিকোর জিম্মায় হস্তান্তরের আদেশ দেন। তবে দুই মেয়ে বাংলাদেশে থাকায় বিষয়টি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের একজন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। গত ১৮ জুলাই তিনি শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com