বছরের সবচেয়ে পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। গত ৬ অক্টোবর রাতে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। ছুটি কাটিয়ে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে ওই দিন বিকেলে নিজের ক্যাম্পাসে ফেরেন আবরার ফাহাদ। ওই দিন শেরেবাংলা হলে নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষে পৌঁছে ফোনে মায়ের সাথে কথাও বলেন। এটাই ছিল মায়ের সাথে তার শেষ কথা। একদল পাষণ্ড রাতে সেই ছেলেকে একই হলের একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে!
শুধু তাই নয়, হত্যার পর আবরারের লাশ টেনেহিঁচড়ে হলের সিঁড়ির পাশে ফেলে রাখা হয়। রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হল থেকে আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই হলের টর্চারসেল নামে পরিচিত ২০১১ নম্বর কক্ষে রাতভর আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ। ঘটনার পরপরই আবরার হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার করা শুরু হয়। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা। মামলা দায়েরের পর ২১ জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। গত ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে ডিবি পুলিশ। চার আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন। তাদের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
চার্জশিটে আবরার হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং ১৪ জনের সম্পৃক্ততা দেখানো হয়েছে অভিযোগপত্রে। আসামিরা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে। হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আটজন আদালতে আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। বাকি ১৩ জনের ১৬১ ধারায় জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড : ওই দিন রাত ৮টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আবরারের কক্ষে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ২০১১ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষে থাকেন ছাত্রলীগের চার নেতা। সেখানে তার মোবাইল ফোন তল্লাশি করেন নেতারা। ওই কক্ষে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ। তারা আবরারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সেটি যাচাই করেন। একপর্যায়ে আবরারকে তার ফেসবুক আইডি খুলতে বলেন। পরে তারা তার ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে তাকে শিবিরের নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন। এর পরই ওই দুই নেতার সাথে থাকা আরো কয়েকজন তাকে মারধর শুরু করেন। আবরারকে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয়। ‘শিবির ধরা হয়েছে’Ñ এমন খবর পেয়ে সেখানে সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারী আরো সাত থেকে আটজন নেতা জড়ো হন। তারাও সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে যায় আবরারের দেহ। রাত ২টার পর তাকে ওই কক্ষ থেকে বের করে হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়।
এজাহারনামীয় গ্রেফতারকৃত আসামি ১৬ জন : মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা বুয়েটের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। তারা হলেনÑ মেহেদী হাসান রাসেল, মুহ্্তাসিম ফুয়াদ, মো: অনিক সরকার ওরফে অপু, মো: মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো: মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো: মাজেদুর রহমান ওরফে মাজেদ, মো: মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাক্্কারুল ইসলাম ওরফে তানভীর, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, আকাশ হোসেন, মো: শামীম বিল্লাহ্্, মো: সাদাত ওরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত, মো: মোয়াজ ওরফে মোয়াজ আবু হোরায়রা ও মুনতাসির আল জেমি।
এজাহারনামীয় পলাতক আসামি ৩ জন : এজাহারনামীয় আসামিদের মধ্যে এখনো তিনজন পলাতক রয়েছেন। তারা হলেনÑ মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল ওরফে জিসান, এহ্্তেশামুল রাব্বি তানিম ও মো: মোর্শেদ ওরফে মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম।
এজাহারবহির্ভূত তদন্তে প্রকাশিত গ্রেফতারকৃত আসামি ৬ জন : তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, আবরার হত্যাকাণ্ডে এজাহারনামীয় আসামি ছাড়াও ছয়জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে গোয়েন্দারা। তারা সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত না থাকলেও তারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সাথে এবং বিভিন্নভাবে আবরার হত্যায় তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তারা হলেনÑ অমিত সাহা, মো: মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, এস এম মাহমুদ সেতু, সামছুল আরেফিন রাফাত, ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না ও মুজতবা রাফিদ। এর মধ্যে মুজতবা রাফিদ পলাতক রয়েছেন।
আবরার হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ১১ জন : বুয়েট ছাত্র আবরারকে হত্যায় সরাসরি যে ১১ জন জড়িত ছিলেন, তারা হলেন- মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, মো: অনিক সরকার ওরফে অপু, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো: মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো: মুজাহিদুর রহমান ওরফে মুজাহিদ, মো: শামীম বিল্লাহ, মো: সাদাত ওরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত, মুনতাসির আল জেমি, এহ্্তেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও খন্দকার তাবাক্্কারুল ইসলাম ওরফে তানভীর।
এ দিকে মেহেদী হাসান রাসেল ও মুনতাসির ফুয়াদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও ঘটনার সাথে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল এবং বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুনতাসির ফুয়াদ ঘটনার নেতৃত্ব ও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে ঘটনা সংঘটনে সহায়তা করেছে। এ ছাড়াও আবরার ফাহাদের লাশ শেরেবাংলা হলের দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে রাখার পর সেখানে মেহেদী হাসান রাসেল বুয়েটের ডাক্তারকে আবরার ফাহাদের লাশ তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং উপস্থিত ছাত্র ও অন্যান্যদের এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে নিষেধ করে। আবরারকে মারধরে ব্যবহৃত ক্রিকেট স্ট্যাম্পসহ অন্যান্য আলামত অপরাধীরা মুনতাসির ফুয়াদের ২০১০ নম্বর রুমে রেখে দেয়।
যারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন : আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত আট আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তারা হলেনÑ ইফতি মোশাররফ হোসেন সকাল, বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, অনিক সরকার, মো: মোজাহিদুর, মনিরুজ্জামান মনির, এ এস এম-নাজমুস শাদাত ও তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর।