চামড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পোশাক শিল্পের পরই চামড়ার স্থান। আশির দশক থেকেই এই শিল্পের নানা সমস্যার কথা বলা হলেও একে একটি সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে আনা যায়নি। পোশাক খাতের প্রতি নজর বেশি থাকায় তা অনেকদূর এগিয়েছে। করোনার কারণে গত দুই বছর রফতানিতে চামড়া খাতের কাক্সিক্ষত অর্জন না থাকলেও গত অর্থবছরে (২০২১-২০২২) রফতানি আয় বেড়েছে ৩২ শতাংশ। চামড়াশিল্পে রফতানির সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে হলে আমদানিযোগ্য কাঁচামাল, শুল্ক ব্যবস্থাপনা, পণ্য ছাড় করা ও ব্যবসা সহজীকরণ নিশ্চিত করা উচিত।
চামড়ার ওপর ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৩০টির ও বেশি ট্যানারি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর দেশে প্রায় ৯৯ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম। কোরবানির সময় পানির চেয়েও কম দামে চামড়া বিক্রি হয়। আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে ও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের খবর খুবই উদ্বেগজনক।
চামড়ার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ খাত দেখার কি কেউ নেই! প্রতিবেশী ভারতে বাংলাদেশী চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ও দামও বেশি। কারণ বাংলাদেশী চামড়ার মান ভালো। সুযোগ নিয়ে কিছু পাচারকারী প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি বছর চামড়া পাচার করে যাচ্ছে। দেশীয় বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের কারখানা প্রতিষ্ঠা, চাহিদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করলে চামড়া পাচার রোধ করা সম্ভব। এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে চামড়াশিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানাগার (সিইটিপি), ডি ওয়াটারিং ইউনিট, পাম্প, জেনারেটর ও ল্যাবের কাজ এখনো শেষ হয়নি। সিইটিপি কার্যকর না থাকায় সব বর্জ্য গিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে পড়ে। ফলে দূষণের কারণে ধলেশ্বরী নদীও এখন হুমকির মুখে।
চামড়া শিল্প নগরে বর্জ্য ও পানি আলাদা করতে ডি ওয়াটারিং ইউনিট আছে ৯টি। তার মধ্যে তিনটি ইউনিটই অকার্যকর রয়েছে। ফলে চামড়া শিল্প নগরের বেহাল দশায়। ফলে নানা সমস্যার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণেও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অপ্রস্তুত চামড়া শিল্প নগরীতে কঠিন বর্জ্য (সলিড ওয়েস্ট) ব্যবস্থাপনা এবং ক্রোম রিকভারি ইউনিটের কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। সিইটিপির কাজ শেষ না করেই চীনা ঠিকাদার চলে গেছে। এ শিল্পনগরীকে উন্নত করতে হলে অবকাঠামো আধুনিকরণ করতে হবে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) চামড়া শিল্প নগরীর শিল্প সমাধানের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পওয়া যায়নি এখনো। ইউরোপ আমেরিকার নামকরা আমদানিকারকদের কাছে সরাসরি চামড়া রফতানি করা যাচ্ছে না। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ভালো ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে এ খাতের রফতানি কাক্সিক্ষত মানের নয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানির ছিল ১২৩ কোটি ডলারেরও বেশি। ২০১৭-১৮ তে তা ১০৮ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০২ কোটি ডলারে নেমে আসে। কোভিডের কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাতের রফতানি কাক্সিক্ষত মানের হয়নি। তবে এ খাত ঘুরে দাঁড়ানোর এখনো অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে জুতার বাজারেও চামড়াশিল্পের বিরাট অবদান রয়েছে। চামড়া ও চামড়াবিহীন প্রধানত দুই ধরনের জুতা তৈরি হয় দেশে। এতে আমাদের স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু পণ্য বিদেশেও রফতানি হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৭৮ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হয় ৮০.৯৬ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৭.৯৩ কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৫.০৫ কোটি ডলারের জুতা রফতানি হয়।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে জুতার মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ চীনের দখলে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮ তে। তবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের এ খাতে অবদান মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ৯০টি দেশে বাংলাদেশের জুতা রফতানি হচ্ছে। সাভারের শিল্পনগরীকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তৈরি করে পরিবেশবান্ধব করা ও সিইটিপির আধুনিকরণ করা জরুরি। সাথে সাথে বিশ্ববাজারের সাথে মিলিয়ে মূল্য প্রতিযোগিতামূলক করা। চামড়াশিল্প পিছিয়ে পড়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো দেশী বাজারে নতুন কোনো ব্র্যান্ড, কোম্পানির প্রতিযোগিতা কম। কমপ্লায়েন্সের অভাব, পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে জটিলতা। পরিবেশবান্ধব চামড়া ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও ডেভেলপমেন্টমূলক কাজ না থাকা।
বাংলাদেশের পশুর চামড়ার মান ভালো, সরবরাহও বেশি হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা না থাকায় বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ২৪০ বিলিয়ন ডলারের চামড়ার বাজার আছে। ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট, পার্টস, ওয়ার্কিং হ্যান্ড গ্লাবস প্রভৃতি। বর্তমানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, সদ্যসমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে সামগ্রিক রফতানি আয় ৩৪.৩৮ শতাংশ বেড়েছে। এতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ১২৫ কোটি ডলার আয় হয়েছে। এ খাতে রফতানি বেশ কয়েক বছর পর শতকোটির ঘরে পৌঁছেছে।
পরিবেশ দূষণজনিত কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর থেকে এই খাতের রফতানি কমতে থাকে টানা দুই বছর শতকোটি ডলারের নিচে রফতানি থাকার পর বিদায়ী অর্থবছর (২০২১-২২) এই খাতটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরটি শেষ হয়েছে ৫২ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার ২০০ কোটি ডলারের রফতানি আয় দিয়ে। আগের অর্থবছরের তুলনায় অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া রফতানি খাতের এই ধারা ধরে রাখা যাবে কি না সেটি এখন প্রশ্ন। এ জন্য আমাদের রফতানিযোগ্য পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে। চামড়া ও চামড়া জাত পণ্যের রফতানি বাড়াতে হলে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ নিতে হবে। দেশের পরিবেশ অধিদফতরের নির্ধারিত মানদণ্ড অর্জন করতে হবে। চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে শতভাগ কাঁচামাল আমাদের দেশে আছে। তথাপিও এই শিল্পের বিকাশ কাক্সিক্ষত মানের নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং সরকারকেও এগিয়ে আসা উচিত। না হলে এই শিল্পের সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কিছু উন্নত দেশ চামড়ার অভাবে তাদের ট্যানারি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সেসব দেশে চামড়াজাত পণ্য তৈরির কারখানা যথারীতি চালু আছে। ফলে সেসব দেশে শিল্পের কাঁচামাল বা ফিনিশড লেদারের চাহিদা রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগালে আমাদের রফতানি আয় বাড়বে।
বিশ্ববাজারের ক্রেতারা এখন বহুমুখী উৎস থেকে চামড়া সংগ্রহ করছেন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। এ জন্য চামড়াশিল্পকে আরো প্রতিযোগিতার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। বিশেষ করে সাভারের শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারকে আরো বেশি কার্যকর করতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী হিসেবে এর উত্তরণ ঘটাতে হবে। এ শিল্পের রফতানি বাড়াতে হলে পরিবেশসম্মত ট্যানারি স্থাপনের বিকল্প নেই। রফতানিকে আরো গতিশীল করার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পাওয়ার জন্য এবং পরিবেশবান্ধব বর্জ্য শোধনাগার ও তার বর্জ্য ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার