মধ্যযুগে হিন্দুধর্মীয় পুনরুত্থানে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মদ্বয় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এরপর ১৮৬৭ সালে ‘হিন্দুমেলা’ নামে দ্বিতীয়বারের জাতীয়তাবাদের পুনরুজ্জীবনে হয় ১৮৮৮-তে দয়ানন্দ সরস্বতীর গো-রক্ষা আন্দোলন। এরই আনুষঙ্গিক ফলে ১৮৮৮ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ সর্বপ্রথম উত্থাপন করেন ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’। অনিরাপদ ভাবায় ক্রমেই প্রকট হওয়া ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান স্লোগানে ১৯৪৭-এ হয়ে গেল ভারত ভাগ। ভারতে অতি সাম্প্রতিককালের হিজাব বিতর্ক, গরুর গোশতের জন্য নির্যাতন, মসজিদের নিচে শিবলিঙ্গ ও মন্দিরের উপরে তাজমহল নির্মিত হওয়ার ছবি ইত্যাদি মুসলিমবিদ্বেষী তৎপরতা, একই সাথে মহানবী সা:-কেও শাসকদলীয় মুখপাত্রের কটূক্তি যেন তৃতীয়বারে অঘোষিত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা। তাই, অবস্থাগত কারণে আজ স্মরণ করতে হয় প্রায় তিন হাজার বছরের ইতিহাসের পাতার সাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষকে।
আর্যদের সর্বপ্রথম ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে তিন বর্ণ এবং পরবর্তী মনডালা অর্থাৎ পুরুষসূক্ত নামক দশম খণ্ডে চার বর্ণের উল্লেখ করা হয়েছে। এর সৃষ্টিতত্তে¡ বলা হয়েছে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত, হাত থেকে ক্ষত্রিয় নামক যোদ্ধা; ঊরু থেকে বৈশ্য নামক বণিক ও পা থেকে শূদ্র নামক ভৃত্য শ্রেণী উদ্ভবের কথা। শর্মা হলো ব্রাহ্মণের উপাধিমূলক আত্মগৌরব প্রকাশক শব্দ। তাৎপর্যপূর্ণ এমন বিশেষণটি নূপুর নামের সাথে যুক্ত হবার যথার্থতা মানবসভ্যতার বিবর্তিত রূপে প্রবর্তিত ধর্মগুলোর জ্ঞাননির্ভর হলে হতো গর্বের বিষয়। কিন্তু জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হয়ে নেহাত রাজনৈতিক দলীয় সঙ্কীর্ণতার বশে মূলত কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ পরিবারের মুসলিম উত্তরাধিকারী ড. মোহাম্মদ ইকবালের উক্তিটিকেই আজ প্রশ্নবোধক শিরোনাম করতে বাধ্য হলাম।
সনাতনী (হিন্দু) ধর্ম : পণ্ডিতদের মতে এটি কোনো একক ধর্ম নয়। বিবিধ বিশ্বাস ও ক্রিয়াকর্মের সংমিশ্রিত ধর্ম। এর অনেক বিষয় বিভিন্নতা থাকলেও সর্বজনীনভাবে অন্তত তিনটি স্বীকৃত বিষয় হলো : গরুর প্রতি শ্রদ্ধা, মৃত্যুর পরে আত্মার দেহান্তর প্রাপ্তি ও ব্রাহ্মণের নেতৃত্ব। Encyclopedia Britannica’s Micropedia-v-vi, p-240 মতে, ‘প্রাচীনকাল থেকে ভারতে অনার্য জনগোষ্ঠীর মাঝে লিঙ্গপূজা পদ্ধতির প্রচলন ছিল। হরপ্পার ধ্বংসাবশেষে পাওয়া ছোট বেলনাকার ও উপরিভাগ গোলাকার স্তম্ভের লিঙ্গমূর্তিটি বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আছে। লিঙ্গপূজা আর্যরা অনুমোদন করেনি। এটি প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে সাহিত্য ও শিল্পকর্মে দেখা যায়।’
ড. নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালির ইতিহাস’ আদি পর্বের (সংক্ষেপিত) ১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “অস্ট্রিকভাষী আদি অস্ট্রেলীয়রা মানুষের একাধিক জীবনে বিশ্বাস করত। কেউ মারা গেলে তার আত্মা কোনো পাহাড় বা গাছ অথবা জন্তু বা পাখি বা অন্য কোনো জীবকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে- এই ছিল তাদের ধারণা। পরে এই ধারণাই হিন্দু পুনর্জন্মবাদ ও পরলোকবাদে রূপান্তরিত হয়। ‘লিঙ্গ’ শব্দটি তো অস্ট্র্রিক ভাষারই দান।”
গভামানায়না (GAVAMANAYANA) অর্থাৎ ‘গরু’ বলি, যা আর্যদের প্রথম দিকে ছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে অনেক স্তবগানে অগ্নিয়া (AGHNYA) অর্থে ‘কিছুতেই হত্যা করা যাবে না’ বলে গরুকেই বোঝানো হতো। তবে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট এ. স্মিথ তার The Oxford history of India বইয়ের ৮৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘৩২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের অভিযানে প্রাচীন ভারতের বিদ্যাপীঠ তক্ষশীলায় (বর্তমান পাকিস্তানের রাজধানী, রাওয়ালপিন্ডি তহশিলের ঢেরি সাহান নামক গ্রাম বলে ধারণা) রাজা অম্বি প্রতিরোধের চেয়ে বরং আলেকজান্ডারকে অভ্যর্থনা জানান এবং তার বাহিনীকে স্বেচ্ছায় ভোজন করানোর জন্য চাষের কাজে ব্যবহৃত তিন হাজার ষাঁড় জবাই করান।’ বইটির ৯৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘Brahmans are said to have been accustomed to eat flesh, … although other people might still eat beef.’ (বলা হয়, ব্রাহ্মণরা মাংস খাওয়ায় অভ্যস্ত, তবে যেগুলো মানুষের শ্রমে সাহায্য করে সেগুলো নয়। এ কথায় শিং থাকা গৃহপালিত গবাদি পশুর প্রতি ব্রাহ্মণের শ্রদ্ধার ইঙ্গিতই বোঝায়, যদিও অন্যরা এখনো এর মাংস খায়)।
উল্লেখ্য, যে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা অতি অমানবিক ধর্মীয় কিছু বিশ্বাসকে আধুনিক সভ্যতার নিরিখে আইন করে রহিত করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু প্রথা জনমানুষের ক্রমেই অগ্রাহ্যের কারণে শিথিল বা বিলুপ্ত হয়েছে। যেমন- পেঁয়াজ, রসুন খাওয়ার নিষিদ্ধতা আজ কেউই মানছেন না। অথচ প্রায় শত বছর আগেও এটি খাওয়ার অভিযোগে মুসলমান ছেলেদের স্কুলে পেছনের বেঞ্চে বসতে হতো।
১৮০২ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি সরকারি ঘোষণায়, মানত করে সদ্যজাত শিশুকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া বা নিক্ষেপ করা নিষিদ্ধ করেন। তবুও ১৮৩২ সালেও কালীপূজায় এক নরবলি ঘটেছে। ১৮২৯-এ লর্ড উইলিয়াম ক্যাভানডিস বেন্টিঙ্ক Regulation XVII of Bengal code দ্বারা সতীদাহ প্রথা রদ করেন। প্রায় ২৭৫ বছর আগে মোগল সম্রাট হুমায়ুন ও তদীয় পুত্র আকবর এই রদের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে Micropedia, V-VIII, P-913-তে বলা হয়েছে। ১৮৩১ সালে খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ তথা ব্রাহ্মণ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় স্বগৃহে গো-মাংস ভক্ষণে এর নিষিদ্ধতা অগ্রাহ্য করেন। ১৮৫৫ সালে লর্ড ডালহৌসি বিধবা বিয়ে আইন বিধিবদ্ধ করেন। ১৮৬২ সালে সর্বপ্রথম এক বর্ণের সাথে অন্য বর্ণের এক বিয়ে অনুষ্ঠান ব্রাহ্মসমাজ গোপনে উদযাপন করে।
ইতিহাসের অপ্রিয় সত্যটি হলো- প্রাচীন বিশ্বের ভারতবর্ষে দ্রাবিড় ও আর্য, চীন, মিসর, ব্যাবিলন, গ্রিস, রোম, ল্যাটিন আমেরিকার মেক্সিকোস্থ মায়া ও আজটেক, পেরুর ইন্কা প্রভৃতি সব সভ্যতায় দেব-দেবীসহ, মূর্তিপূজা, নরহত্যা, বর্ণবাদ ও প্রাকৃতিক রহস্যজনিত বিবিধ বিশ্বাস ছিল। এর সব কিছুই ধারক ও বাহকস্বরূপ ভারতে একমাত্র বর্ণবাদী সনাতনীরাই (হিন্দু ধর্মাবলম্বী) তাদের সভ্যতাকে আজো যেন জীবন্ত করে ধরে রেখেছে। পক্ষান্তরে অন্য সব সভ্যতাই পরবর্তী প্রায় এক-দেড় হাজার বছরের মধ্যে বিবর্তিত বিশ্বাসে প্রবর্তিত ইহুদি, খ্রিষ্টান, ইসলাম, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ প্রভৃতি ধর্মে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় আজ তারা যেন রূপকথার খোরাক হয়ে রয়েছে। তাই প্রশ্ন, মানবতা আর সভ্যতা আগাচ্ছে, না পেছাচ্ছে?