ছোট ছোট বিনিয়োগের পরিশোধ হার এবং প্রবণতা এ দেশে সব সময়ই সন্তোষজনক। খেলাপি হয় বড় বড় ঋণ বা বিনিয়োগের বড় বড় কিস্তি। সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক অংশই শিল্প খাতের ঋণ। কিন্তু এমনটা হওয়ার তো কথা ছিল না। ২০২১ এবং ২০২২ সালে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। সারা পৃথিবীতেই শিল্পকারখানাগুলো করোনাকালে আর্থিক রেয়াত ও বিভিন্ন ধরনের মঞ্জুরি পেয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প খাতে মোট ঋণের স্থিতি ছিল ছয় লাখ ২৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ২৬২ কোটি টাকা (অর্থাৎ মোট ঋণের ৮৩%)। তার আগের বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ নাগাদ শিল্প ঋণের স্থিতি ছিল পাঁচ লাখ ৭২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। ওই সময়ে শিল্প খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৫ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। এই হিসাবে এক বছরের মধ্যে শিল্প খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় তিন হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা এবং ঋণ স্থিতি বাড়ে ৫৬ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।
এই প্রবণতা সাক্ষ্য দেয় যে, ঋণের একটি বড় অংশ খেলাপি হয়ে পড়ে। সরকার অনেক চেষ্টা কসরত করেও খেলাপি ঋণের ফাঁদ থেকে বাঁচতে পারছে না। বরং দিনকে দিন এই ফাঁদের জটিল গিরায় আটকে যাচ্ছে জনগণের অর্থ। মাঝখান থেকে ধরা খাচ্ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। বড় উদ্যোগের বড় ঋণের বড় ধাক্কায় বেসামাল হয়ে আর্থিক খাতে নতুন উপায় উত্তরণের চেষ্টায় এসএমই খাতে প্রবাহ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সাধারণ প্রবণতা হলো, বড় শিল্পে বড় আকারে ঋণদান। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে বড়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সংখ্যা এবং ঝামেলা বেশি বলে মনে হলেও ঋণ পরিশোধে তারাই পারঙ্গম বেশি।
সরকারেরও তাই উচিত হবে, বড় ঋণ আদায়ে আরো স্বচ্ছতা এবং কঠোরতার পাশাপাশি এসএমই খাতে আরো উদার, প্রো-অ্যাকটিভ ঋণনীতি অনুসরণ করা। তাতে দেশেরও উন্নতি হবে; ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে স্বস্তি পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ নাগাদ ব্যাংকিং খাতের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকের মোট ঋণের ৩০.৪৭% শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে শিল্প খাতে। এই বিপুল অঙ্কের ঋণের যে অসংখ্য কিস্তি খেলাপি হয়েছে, তা আদায় করাই এখন সরকার ও ব্যাংকগুলোর সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
ঋণগ্রহীতাকে যদি ঢালাওভাবে এবং রাজনৈতিক সুপারিশে এভাবে ঋণ দেয়া হয়, কোনো বাছ-বিচার, যাচাই-বাছাইয়ের তোয়াক্কা করা না হয়, তাহলে তো এভাবে ঋণ পরিশোধের কিস্তি খেলাপি বাড়তেই থাকবে। তাদের সুবিধার্থে তফসিল, পুনঃতফসিল, মওকুফ সবই করা হয়। কিন্তু তারা অধিকাংশই যে ঋণ নিয়েছেন শোধ দেবেন না বলেই, সেই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার উপায় কী? উপায় তো একটাই, যেভাবেই হোক না কেন ঋণ আদায় করা। আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দিতে হবে। সেই মতো আদায় করতে ব্যর্থ বা অপারগ হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যা অন্য সবার জন্য দৃষ্টান্তমূলক হবে এবং একটি জবাবদিহিতার পরিবেশ ও মানসিক পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ধরনের বেশ কিছু বাস্তবমুখী কর্মকৌশল বিস্তারিতভাবে বিধৃত হয়েছে গত ৩০ জুন ঘোষিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রণীত আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে। মুদ্রানীতি আসলে গোটা অর্থনীতির কৌশলপট বাস্তবায়নের এক অনিবার্য অভিমুখ, যা মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, যা আমরা প্রতিটি পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে টের পাচ্ছি। মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে মুদ্রার মান কমে যায়। ফলে অর্থের প্রবাহ কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। এবারে মুদ্রানীতির প্রধান অভীষ্ট বা উপলক্ষ তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সারা বিশ্বেই নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর দাম। যুক্তরাষ্ট্রে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৯.৩ শতাংশ, রাশিয়ায় ১৭.৮ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৩ শতাংশ। ভারতের নিত্যপণ্যেরও দাম কতকটা আমাদের দেশের মতোই। চলতি অর্থবছরে প্রথমার্ধে বাংলাদেশের নিত্যপণ্যে গড় দাম বেড়েছে ৮.৩%। সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৫% এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬% হবে বলে ধারণা করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি ব্যাংক রেট বাড়াবে? বাণিজ্যিক ব্যাংককে দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদ হার বাড়ালে ব্যাংকগুলোও সুদহার বাড়াবে বা বাড়াতে বাধ্য হবে। কারণ ব্যাংকগুলোকেও তো চলতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ মোতাবেক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নগদ জমার অনুপাত বাড়ালে তাদের ঋণদান ক্ষমতা কমবে। উদ্যোক্তাদের মূলধন বিনিয়োগে ভাটা পড়বে। নতুন উদ্যোক্তারা শুরুতেই নিরাশ হবে।
এমনিতেই করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সরবরাহ বিন্যাস (গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন)-এ ধাক্কা দিয়েছে। ফলে আমদানিজনিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বাজারে যে উত্তাপ বিরাজ করছে, তাকে প্রশমিত করাই এখন মুদ্রানীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ। সরকার এমন অনেকগুলো পণ্য আমদানির ‘এলসি মার্জিন’ বাড়িয়ে এবং বিলাসসামগ্রী আমদানি কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে সঞ্চয়ের সুদ বৃদ্ধি বা কাঠামোগত সঞ্চয়কে উৎসাহিতকরণের মতো পদক্ষেপ। তবে দ্রব্যমূল্যের সরকার নির্ধারিত ‘রেট চার্ট’ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যহার মানতে ব্যবসায়ীদের সাড়া অতীতেও পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া সব পণ্যের মূল্যহার বেঁধে দেয়া সম্ভবও নয়। পুরো মূল্যব্যবস্থাই নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ওপর। জোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি হলে দাম বাড়বেই। খোলাবাজার অর্থনীতিতে দর দাম ধার্য হয় বাজারশক্তি ও ক্ষমতার কারণেই। পাট চাষের চেয়ে ধান চাষ বেশি লাভজনক হলে কৃষক ধানই লাগাবেন। ধান বা পাট চাষের চেয়ে জমি সামান্য গভীর করে পানি আটকিয়ে মাছের ঘের করা আরো লাভজনক বিবেচনা করলে কৃষি ছেড়ে মানুষ মাছ চাষেই বেশি ঝুঁকবে। এটাই বাজারের নিজস্ব এখতিয়ার শক্তি। ‘অপরচুনিটি কস্ট’ যেখানে বড় বিবেচক সেখানে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বা শাসন মান্য হবে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক তাই অর্থহীন।
অপ্রয়োজনীয় বা বিলাসদ্রব্য আমদানির ‘এলসি মার্জিন’ অনেকটা (ক্ষেত্র বিশেষে ৭৫ থেকে ১০০% পর্যন্ত) বাড়ানোতে এগুলোর চাহিদাও কমবে; বৈদেশিক মুদ্রার চাপও কমবে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বা বিলাসদ্রব্য গোটা আমদানির কতটুকুই বা? এতে কি বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের ওপর খুব একটা প্রভাব পড়বে? কিংবা মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর? সম্ভবত না।