বাংলাদেশ এখন গ্যাস সঙ্কটে ধুকছে৷ এর প্রভাব পড়ছে শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ এবং গৃহস্থালি খাতে৷
গ্যাস সঙকটের কারণে একদিকে যেমন ভুগছে সাধারণ মানুষ, অপরদিকে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানার উৎপাদন৷ দেশের রফতানি আয়ের মেরুদণ্ড পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, এই খাতে গ্যাস সঙ্কটের কারণে শতকরা ২০-৩০ ভাগ উৎপাদন কমেছে৷ তাদের অভিযোগ, সরকারের কাছ থেকে সঙ্কট সমাধানের কোনো আভাস মিলছে না৷
আর এই খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঙ্কট সমাধানে সরকারের যে উদ্যোগ তাতে আশু সঙ্কট কাটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷
দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত আছে ১০ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট৷ গ্যাসের প্রতিদিনের মোট চাহিদা তিন হাজার আট শ’ মিলিয়ন ঘনফুট৷ সরবরাহ আছে দুই হাজার আটশ মিলিয়ন ঘনফুট৷ ফলে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না৷
এরমধ্যে বিদ্যুৎ খাতের চাহিদা দুই হাজার দুইশ ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ সরবরাহ আছে এক হাজার ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ তবে গত দুই-এক দিনে সরবরাহের পরিমাণ নয় শ’ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে গেছে৷
সার কারখানায় গ্যাসের দৈনিক চাহিদা তিন শ’ ২০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ সরবরাহ করা হয় এক শ’ ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ এলএনজির চাহিদা আট শ’ ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ সরবরাহ আছে চার শ’ ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ গৃহস্থালির রান্নার কাজে ছয় শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও এখন সরবরাহ করা যাচ্ছে সর্বোচ্চ চার শ’ মিলিয়ন ঘনফুট৷
দেশে দুভাবে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয়৷ দেশীয় উৎপাদন দিয়ে এবং আমদানি করে৷ দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক প্রায় দুই হাজার তিন শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়৷ আর আমদানি করা হয় সাত শ’ থেকে সাত শ’ ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ এলএনজি আমদানি করা হয় চার শ’ ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট৷
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় পাঁচ শ’ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি নিয়মিতভাবে কেনা হচ্ছে৷ স্পট মার্কেট থেকে আনা হতো দুই শ’ মিলিয়ন ঘনফুট৷ তবে গত জুলাই মাস থেকে উচ্চমূল্যের কারণে কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে৷ এই ঘাটতি মেটানোর জন্য দেশীয় কূপগুলো থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা৷
সুতরাং গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে হলে হয় উৎপাদন বাড়াতে হবে অথবা আমদানি বাড়াতে হবে৷ আমদানি বাড়ানো কঠিন। কারণ বাংলাদেশ এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার সঙ্কটে আছে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশে গ্যাসের প্রকৃত মজুত কত, নতুন গ্যাস কূপ খনন কবে সম্ভব হবে তা নিশ্চিত নয়৷ এই কাজে রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এবং রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম নিয়োজিত আছে৷
গৃহস্থালিতে সঙ্কট
চলমান এই গ্যাস সঙ্কটের কারণে গৃহস্থালির রান্নার কাজে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ঢাকাসহ সারাদেশেই এই সঙ্কট চলছে৷
ঢাকার নারিন্দার বাসিন্দা এম কে জিলানী বলেন, ‘গত এক বছর ধরেই আমরা গ্যাস সঙ্কটে আছি৷ এখন সেটা আরো তীব্র হয়েছে৷ এখন সারা দিনে সন্ধ্যার পর কয়েক ঘণ্টার জন্য গ্যাস থাকে৷ অন্য সময় যে গ্যাস থাকে তা দিয়ে চাও বানানো যায় না৷’
তিনি বলেন, ‘এখন এক বেলা রান্না করে তিন বেলা খাই৷ আগে সকালে নাস্তায় রুটি খেতাম এখন পান্তা ভাত খেতে বাধ্য হচ্ছি৷’
রামপুরার বাসিন্দা কান্তা আফরোজ বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৯টার মধ্যে গ্যাস চলে যায়৷ আসে দুপুরের পরে ৩টার দিকে৷ তাই সকাল ৯টার মধ্যে নাস্তা এবং দুপুরের খাবার তৈরি করতে না পারলে বিপাকে পড়ে যাই৷’
ঢাকার প্রায় অর্ধেক এলাকায় এই গ্যাস সঙ্কট চলছে৷ ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা৷
গ্রাহকদের অভিযোগ, ‘গ্যাস না থাকলেও বিল পুরোটাই আদায় করা হচ্ছে৷’
দেশের মোট চাহদার শতকরা ১০ ভাগ গৃহস্থালির৷ আর এই খাতে গ্যাস সঙ্কট চলছে দুই বছর ধরে৷ প্রথমেই এখানে সরবরাহ কমানো হয়৷ দেশে এখন গৃহস্থালির কাজে গ্যাস লাইন দেয়া বন্ধ আছে৷ ফলে এলপি গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে৷
শিল্প উৎপাদন কমছে
গ্যাস সঙ্কটে দেশের বড় শিল্প কারখানাগুলোতে কমেছে উৎপাদন৷ বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে তৈরি পোশাক শিল্প৷ এই খাতে গড়ে উৎপাদন কমেছে শতকরা ২০-৩০ ভাগ৷
আবার যারা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবহার করছেন তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে৷ বাজার থেকে চড়া দামে জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে তাদের৷ উৎপাদন কমে যাওয়া ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রফতানি আয়ে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের৷
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, ‘আজকে (রোববার) নিট ওয়্যার খাতে গত মাসে রফতানির যে হিসাব বের হয়েছে তাতে রফতানি ৬.১ ভাগ কমে গেছে৷ আগের মাসে রফতানি বেড়েছিলো ২৫ শতাংশ৷ সেই হিসাব করলে আমাদের রফতানি কমেছে শতকরা ৩১ ভাগ৷’
তিনি বলেন, ‘গ্যাস সঙ্কটের কারণে আমার কারখানায় উৎপাদন ৫০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে৷ কারণ গ্যাস না থাকার কারণে ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলো সময়মতো এবং চাহিদামতো ফেব্রিক সরবরাহ করতে পারছে না৷ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এখন তার ক্যাপাসিটির ৫০ ভাগের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না৷’
তার কথা, ‘এতে রফতানি যেমন কমছে তেমনি শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷ তারা ওভারটাইম করতে পারছে না৷ ফলে তারা বাড়তি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷’
তিনি বলেন, ‘আমরা বার বার সরকারের সঙ্গে এই গ্যাস সমস্যা নিয়ে কথা বলছি ৷ কিন্তু কোনো সমাধানের আশ্বাস পাচ্ছি না৷’
বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘গ্যাসের সাথে ডলার সঙ্কট এবং ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় আমরা সঙ্কটে আছি৷’
তিনি জানান, ‘যেসব কারখানা পুরোপুরি গ্যাসের ওপর নির্ভশীল তাদের উৎপাদন কমে গেছে৷ আর যাদের ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে৷ বাজার থেকে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল কিনে তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে৷ আর সব মিলিয়ে উৎপাদন কমে যাচ্ছে৷’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে গ্যাস নিয়ে বাস্তবে কোনো বিজ্ঞান ভিত্তিক জরিপই হয়নি৷ আসলে আমাদের কতটুকু গ্যাস আছে, কী পরিমাণ সম্ভাবনা আছে তা নিয়ে আমাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে৷ ফলে আমরা জানি না যে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে৷ সরকারের যে উদ্যোগ তাতে আশু সঙ্কট কাটার কোনো লক্ষণ দেখছি না৷’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘এই সঙ্কটের নামে এখন নানা গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে৷ বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা বলে একটি গোষ্ঠীকে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করতে দেয়া হয়েছে৷ তারা বসে বসে পয়সা নিচ্ছে৷ এক টাকার বিদ্যুৎ পাঁচ টাকায় কিনছি৷ এক টাকা তিন পয়সার গ্যাস এখন আমরা আমদানি করছি ৮৩ টাকায়৷ একটা কূপ খনন করতে দেশের প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের লাগে ৬০-৭০ কোটি টাকা৷ অথচ রাশিয়ন গ্যাজপ্রমকে দিয়ে ৬৬টি কূপ খনন করানো হলো প্রতিটি ২৪০ কোটি টাকা দিয়ে৷ দুর্নীতি করবেন আবার মানুষের দু:খ ঘোঁচাবেন এটা তো হয় না৷’
চেষ্টা করছে পেট্রোবাংলা
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘দেশে গ্যাস সংকটের কারণ সরবরাহ কম৷ চাহিদা অনুয়ায়ী আমরা সরবরাহ করতে পারছি না৷ দেশে উৎপাদনে ঘাটতি আছে আবার স্পট প্রাইস বেড়ে যাওয়ায় আমরা স্পট আমাদানিও এখন বন্ধ রেখেছি৷ আগে যে দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তি ছিলো সেই গ্যাসই আনা হচ্ছে৷’
তার কথা, ‘সারাবিশ্বেই জ্বালানির সঙ্কট চলছে৷ আমরাও তার বাইরে নই৷ তবে আমরা দেশীয় উৎপাদন এবং আমদানি দুটিই বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি৷ নতুন কুপ খনন ও গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজ চলছে৷’
তবে কবে নাগাদ এই সঙ্কটের সমাধান হতে পারে তা জানাতে পারেননি তিনি৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে