২০২২ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা (আবশ্যিক ) প্রথম প্রশ্নপত্রের প্রথম দিনেই সৃজনশীল নামক প্রশ্নপত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উল্লেখিত প্রশ্নপত্রের এগার নম্বর প্রশ্ন নিয়ে মূলধারার টিভি চ্যানেলসহ সর্বস্তরে সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই অভিযোগের পক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে। কিন্তু যা সর্বনাশ হবার সেটা তো হয়েই গেছে। কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীরা ওই প্রশ্ন পড়েছে এবং নম্বর পাবার আশায় খুব ভালোভাবে সেই প্রশ্নের উত্তরও দিয়ে দিয়েছে। তবু সরকারের এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই।
কিন্তু গোটা প্রশ্নপত্রটা যদি খুঁটিয়ে দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে, পুরো প্রশ্নপত্রই সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে পরিপূর্ণ। আমরা একে একে প্রশ্নগুলো ধরে ধরে আলোচনা করব এবং এর পেছনের কারণগুলো বের করার চেষ্টা করবো।
প্রথম উদ্দীপক প্রশ্নে (গদ্য) সবিতা নামের হিন্দু এক মেয়েকে নিয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে। যে পড়াশোনা শেষ করে একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করে। পরে তার বিয়ের সময় যৌতুকের দাবি ওঠায় সে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরহিতে জীবন উৎসর্গ করাই তার ধর্ম হয় ওঠে। ভালো কথা। হতেই পারে। কিন্তু কথা হলো, এখানে কোনো মুসলমান মেয়েকে আনা হলো না। সবিতার পাশাপাশি কোনো রহিমা বা রাহেলাকেও আনা যেত। যায়নি, কারণ, বর্তমান শিক্ষকদের মাথায়, কোনো ভালো কাজের ক্ষেত্রে, পরহিতে জীবন বিসর্জন দেয়ার জন্যে হিন্দু নারী বা পুরুষ ছাড়া কোনো মুসলমান নারী বা পুরুষ মাথায় কাজ করে না। এই কাজ না করার কারণ পরে বলা হবে।
দ্বিতীয় উদ্দীপকে অমিত বাবু (আবার সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক) নামে এক ভূমি অফিসের নায়েবকে নিয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে। যে অমিত অত্যন্ত সৎ, দক্ষ এবং নিজ উদ্যোগে অফিসে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে লিখে রাখেন, ‘এই অফিসে কোন ঘুষের লেনদেন হয় না।’ এবং গল্পের শেষে বলা হয়, তার পেছনে ঘুষখোররা লেগে থাকলেও, তিনি তার আদর্শে অটল থাকেন এবং অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি কোনো দিন। ভালো কথা। এমন মানুষই তো আমরা আমাদের দেশে চাই। কিন্তু সেই মানুষ কি আমরা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে শুধু হিন্দু সম্প্রদায় থেকেই পাবো? প্রশ্নটা এখানেই।
তিন নম্বর উদ্দীপক প্রশ্নে নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে বলা হয়েছে। এই উদ্দীপক নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও, প্রশ্ন থেকে যায়। অন্য দেশের মহান মানুষের পাশাপাশি আমাদের দেশের মহান মানুষদের নিয়ে আসা কি যায় না?
চতুর্থ উদ্দীপক প্রশ্নে একাত্তরকে নিয়ে আসা হয়েছে। একত্তরের বর্ণনায় আমরা দেখি কাশেম নামে স্থানীয় রাজাকারের ইশারায় হিন্দু কেষ্টবাবুকে পাকিস্তানি মিলিটারের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়। এখানে শুধু হিন্দুকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি, নির্মমভাবে মুসলমানকে ছোট করা হয়েছে। এই গল্প পড়ে, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা শুধু এটাই জানবে যে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে, মুসলমানদের হাতে হিন্দুরা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছিল। এই আরো ইঙ্গিত করে, মুসলমান মানেই খারাপ। আমাদের মনে রাখা দরকার, ১৯৭১ সালের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ওই সময়ে শুধু হিন্দু নিধন হয়নি, বিপুলসংখ্যক বিহারি মুসলমান এবং বাঙালি মুসলমানও নিধন হয়েছিল। সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার পরিবর্তে একপেশে ইতিহাস তুলে ধরা হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মিথ্যা ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে। যা কোন দেশে কোন সময়ে কাম্য নয়।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ উদ্দীপক প্রশ্নে (খ বিভাগ) দুটি কবিতা, একটি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং অপরটি কবি
সুফিয়া কামালের কবিতা বেছে নেয়া হয়েছে। কবি সুফিয়া কামালের কবিতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা হয়, কবি সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামীর নাম কি? কবি সুফিয়া কামালের স্বামীর খবর নেয়াটা কি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্যে খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল?
সপ্তম উদ্দীপকে আরেকটি কবিতা সংযোজন করা হয়েছে, যেটা নিয়ে আলোচনা না করলেও চলবে।
গ-বিভাগে উপন্যাস থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে লালসালু উপন্যাস বেছে নেয়া হয়েছে।
অষ্টম উদ্দীপক প্রশ্নে উপন্যাস সংশ্লিষ্ট যে গল্প ফাঁদা হয়েছে সেখানে দেখা যায়, জব্বার আলী নামে এক লোক স্বপ্নে এক কামেল পীরের মাজার খুঁজে পায় এবং পরে সেখানে মাজার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জব্বার আলী ওই মাজারের খাদেম হিসেবে নিয়োজিত হয়। গল্পটা পড়লে মনে হয়, এই দেশের মুসলমান সম্প্রদায় স্বপ্নে শুধু মাজার দেখে এবং পরে মাজার পূজার প্রচলন করে। এভাবেই উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্রে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে পদে পদে লাঞ্ছনা আর অপমান করা হয়েছে।
নবম উদ্দীপকের গল্প আরো হাস্যকর করে তোলা হয়েছে। রিকশাচালক সাহেব আলীর মেয়ে সালেহার প্রাইমারির পর আর পড়া হয়নি। বয়স ১২/১৩। তাকে মোবাইলযোগে প্রবাসী পাত্রের সাথে বিয়ে দেয়া হয় এবং বেশ কয়েক বছর পরে পাত্র দেশে ফিরলে দেখা যায়, পাত্রের বয়স পঞ্চাশ। বাল্যবিবাহ রোধের গল্প। ভালো কথা। কিন্তু বাল্যবিবাহ শুধু মুসলমানের ঘরেই হয়। প্রথম গল্প (সবিতার গল্প) এবং এই গল্পের তুলনামূলক বিচার করলেই, পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হিন্দু ঘরের মেয়েরা লেখাপড়া করে, চাকরি করে এবং বিয়ের যৌতুক বা অন্য কারণে, বিয়ে না হলে তারা পরহিতের কাজে নিজেকে সমর্পণ করে।
অন্যদিকে সালেহা নামের মুসলমান ঘরের মেয়েদের বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয় না।
দশম উদ্দীপক প্রশ্নগুলো সিরাজউদ্দৌলা নাটক থেকে নেয়া। নাটক সংশ্লিষ্ট জুলিয়াস সিজারের গল্প বলা হয়ে। এই গল্প মোটামুটি সিরাজউদ্দৌলার সাথে সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে।
এবার আসা যাক, বহুল বিতর্কিত একাদশ এবং শেষ প্রশ্ন সম্পর্কে। যে প্রশ্ন বিতর্কিত হয়েছে। এখানে নেপাল ও গোপাল নামে দুই ভাইয়ের গল্পকে কেন্দ্র করে সিরাজউদ্দৌলা নাটকের সাথে সামঞ্জস্য করা হয়েছে। সামঞ্জস্য করতে যেয়ে শুধু সিরাজউদ্দৌলাকে ছোট করা হয়নি, মুসলমান এবং হিন্দু সম্প্রদায়, উভয়কেই ছোট করা হয়েছে। নেপাল ও গোপাল নামে দুই হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাই তাদের জমি নিয়ে বিরোধে জড়িত হয়। নেপাল তার ভাইকে শায়েস্তা করার জন্যে, আব্দুল নামের এক লোকের কাছে, তার অংশের জমি বিক্রি করে দেয়। আব্দুল সেখানে ঘরবাড়ি করে থাকতে শুরু করে। কোনো এক কোরবানি ঈদের সময়, আব্দুল তার বাড়ির সামনে (প্রশ্নে আছে নেপালের বাড়ির সামনে) গরু জবাই করলে, নেপালের মন এতটাই খারাপ হয় যে, সে ভারতে চলে যায়।
প্রথম প্রশ্ন, গরু কোরবানিতে নেপালের মন খারাপ হবে কেন? সে তো তার জমি বিক্রি করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, মন যদি খারাপই হয়, সে নিজ দেশ ছেড়ে চলে যাবে কেন? তৃতীয়ত, যদি যায়, তাহলে শুধু ভারতে কেন? পৃথিবীতে কি ভারত ছাড়া আর দেশ নেই? সেখানে কি বসবাস করা যায় না?
আচ্ছা, আমরা গল্পটাকে একটু উল্টে দেই। ধরে নেই, হাবিল আর কাবিল নামে দুই মুসলমান ভাইয়ের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ লেগেছে। এবং কাবিল তার ভাইকে শাস্তি দেয়ার জন্যে নরেন নামের এক হিন্দু লোকের কাছে নিজের জমির অংশ বিক্রি করে দেয়। এবং যথারীতি, নরেন দুর্গা পুজার সময়, তার বাড়ির সামনে (অর্থাৎ কাবিলের বাড়ির সামনে) পূজা মণ্ডপ সাজিয়ে, দুর্গার বিশাল মূর্তি গড়ে পূজার আয়োজন করলো। এতে কি কাবিল মন খারাপ করবে? যদি করে, সে কি দেশছাড়া হতে চাইবে? যদি হয়, তাহলে সে কোন দেশে যেতে পারে? সৌদি আরব, কাতার, ওমান, সিরিয়া বা ইরান? অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো জায়গায়, হিন্দু-মুসলিম মন কষাকষি হলে বা বিবাধ বাঁধলে, হিন্দুরা যাবে হিন্দু রাষ্ট্রে আর মুসলমানরা যাবে মুসলিম রাষ্ট্রে। যার অর্থ দাঁড়ায় নিজ রাষ্ট্র বলে এই দেশের হিন্দু বা মুসলমান জনগোষ্ঠীর কিছু নেই।
আসলে এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা প্রথমপত্রের সৃজনশীল প্রশ্নের আড়ালে শিক্ষার্থীদের খুব কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সৃষ্টিশীল বীজ বুনে দেয়া হয়েছে। যে বিদ্বেষ নিয়ে কিশোর বয়সী এসব শিক্ষার্থী কখনো চিন্তা করত না, তাদেরকে বোর্ড পরীক্ষার মতো পরীক্ষার প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে বিদ্বেষমূলক চিন্তা করতে শুধু উস্কে দেয়া হয়নি, বরং পুরোদস্তুর বাধ্য করা হয়েছে। শুধু হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ নয়, মুসলমান-মুসলমান বিদ্বেষের বীজও বোনা হয়েছে। এসব বিদ্বেষের বীজ বোনার পেছনে দীর্ঘ ঐতিহাসিক কারণ আছে। কোনো কাজ আকাশ থেকে পড়ে না। প্রশ্নকর্তারা আকাশ থেকে এসব প্রশ্ন করেননি। এর পেছনে আছে ঐতিহাসিক কারণ। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে শুরু থেকে, প্রথমে রাজাকার মানেই দাঁড়ি-টুপি এবং আরো পরে সন্থ্রাসী মানেই দাঁড়ি-টুপি- এই ইমেজ দিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী জেনারেশনকে গড়ে তোলা হয়েছে। যে ইমেজের ছবি সহজে মুছে ফেলা যাচ্ছে না অথবা মুছে দেয়া হচ্ছে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ইমেজ শুধু সমাজকে নির্দেশ করে না, সমাজও ইমেজ নির্মাণ করে। আমাদের সমাজে এভাবেই মুসলমানদের নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে হিন্দু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হয় না বললে মিথ্যা বলে হবে। অবশ্যই হয়। কিন্তু যতটুকু হয়, প্রচার হয় তার শতগুণ। সব থেকে বড় কথা, যদি খুঁজে দেখা হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন শ্রেণি নির্যাতিত হয়? আমরা দেখতে পাবো- সেই অন্তজ বা গরিব শ্রেণির হিন্দু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। যে গরিব শ্রেণি মুসলমানদের মধ্যেও আছে এবং তারাও ঠিক একইভাবে নির্যাতিত হয়। উচ্চ শ্রেণি সব দেশে, সব কালে নিরাপদ থাকে।
যাক, এভাবে স্বাধীনতার পর থেকে এই দেশের মুসলমানের এমন একটা ইমেজ তৈরি করা হয়েছে যে মুসলমান মানে শুধু রাজাকার আর সন্ত্রাসী। মুসলমান মানে লেখাপড়া করে না, মুসলমান মানে বাল্যবিবাহ আর বহুবিবাহে উৎসুক জনগোষ্ঠী, মুসলমান মানে মাজার-পীর-দরবেশ নিয়ে মত্ত জাতি, মুসলমান মানে চোর-জোচ্চর, ছ্যাচড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্নকর্তারা স্বাধীনতা-উত্তর কৃত্রিমভাবে নির্মিত এই মুসলমান ইমেজের জেনারেশন। তারা এসব চিন্তাভাবনা নিয়েই বড় হয়েছে। কাজেই তাদের হাত দিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রশ্নই বের হয়ে আসবে।
শেষ কথা, দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক কারণও এর জন্যে অনেকটা দায়ী। এই সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় না যেয়ে শুধু এইটুকু বলি, উত্তর-উপনিবেশিক মন কখনো স্বাধীন হতে পারে না। তাকে স্বাধীনতা দিয়ে দিলেও, ভেতরের inferiority complex মন থেকে মুছে যায় না। হীনমন্যতা শুধু ক্রমাগত নিজেকে ছোট করতে থাকে। উত্তর-উপনিবেশিক মন এভাবেই আমাদের ছোট করতে করতে আজকের সৃজনশীল প্রশ্নে এসে ঠেকেছে। সৃষ্টির পরিবর্তে অনাসৃষ্ট যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু অনাসৃষ্টির মতো ধ্বংসযজ্ঞ অন্তত শিক্ষার ক্ষেত্রে বরদাস্ত করা যায় না।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব