স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের নন ফান্ডেড বিনিয়োগে (ঋণ প্রদানে) বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েছে। অর্থের পরিমাণ বিবেচনায় এটি বহুল আলোচিত হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট, অ্যাননটেক্স ও নাবিল গ্রুপের কেলেঙ্কারিকেও ছাড়িয়ে গেছে। স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক বন্ডেড ওয়্যারহাউসের লাইসেন্সবিহীন অখ্যাত দুটি প্রতিষ্ঠানকে ১৫৯ কোটি ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৩৯২ ডলারের ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা দিয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা)।
এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক একক গ্রাহকের যে সীমা রয়েছে তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। শুল্ক সুবিধাভুক্ত ব্যাক টু ব্যাক এলসির ক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানির বাধ্যবাধকতা থাকলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো পণ্যই রপ্তানি হয়নি। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানের কারখানায় অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া যায়নি আমদানিকৃত কাঁচামাল কিংবা কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত কোনো পণ্যের মজুদ পর্যন্ত।
ফান্ডেড ঋণ বলতে ব্যাংক থেকে সরাসরি টাকা দেওয়াকে বোঝায়। আর নন-ফান্ডেড বলতে এলসি, গ্যারান্টিসহ বিভিন্ন দায়কে বোঝানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, কোনো ব্যাংক ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলিয়ে তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ কোনো কোম্পানি বা গ্রুপকে দিতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে এ নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠান দুটি বন্ধ আছে। ফলে ব্যাংকটির এ অর্থ আদায়ে মারাত্মক অনিশ্চয়তা রয়েছে। যদিও ব্যাংকটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এসব বিনিয়োগের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত রাখা আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, এ দুটি প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি সরকারি সুবিধায় শুল্কছাড়ের অপব্যবহার করেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটি। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, বড় অংকের এ টাকার একটা অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মো. জাফর আলম আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন কারণেই একটা ঋণ বকেয়া ও শ্রেণিকৃত হয়ে পড়তে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি। এরই মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে মামলাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নিয়েছি। কারণ এগুলো জনগণের টাকা। এটা আদায় করতে যা যা করণীয় সবই করা হবে। এ ছাড়া এসব ঋণের বিপরীতে আমরা পর্যাপ্ত জামানতও রেখেছি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা অনুযায়ী, শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে লাইসেন্সের মেয়াদ ২ বছর এবং ৫ হাজার টাকা ফি দিয়ে দুবছর অন্তর তা নবায়ন করতে হয়। আর পণ্য প্রস্তুতের পর ২৪ মাস এবং বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরও বেশি সময় তা ওয়্যারহাউসে রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে ২০০৩ সালের এপ্রিলে লাইসেন্স ইস্যু করার পর এ পর্যন্ত আর নবায়ন করা হয়নি। বিধিমালা অনুযায়ী, এ প্রকৃতির প্রতিষ্ঠান অহস্তান্তরযোগ্য। এ বিধি অমান্য করে শার্প নিটিংয়ের মালিকানা একাধিকবার হস্তান্তর হয়েছে। উপরন্তু, এমন প্রতিষ্ঠান বন্ডের অধীন শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় পড়ে না কোনো যুক্তিতেই। এর পরও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এ প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিপুল অংকের এলসি ইস্যু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বনানী শাখা নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করেই গাজীপুর সিটির অন্তর্ভুক্ত টঙ্গীর পাগার এলাকায় (হোল্ডিং নম্বর ১২৩) অবস্থিত শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অনুকূলে শুল্ক রেয়াতি সুবিধায় আমদানির জন্য এলসি ইস্যু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৮৮৯টি ব্যাক টু ব্যাক এলসি করা হয়েছে, যার মোট পরিমাণ ১৫৮ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। শুল্ক রেয়াতি সুবিধাভুক্ত ব্যাক টু ব্যাক এলসির ক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানির বাধ্যবাধকতা থাকলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো পণ্যই রপ্তানি হয়নি। এমনকি গ্রাহকের কারখানায় আমদানিকৃত কাঁচামাল বা তা থেকে প্রস্তুতকৃত পণ্যের মজুদও খুঁজে পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কারখানাটি প্রায় ৩ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে।
এদিকে গাজীপুরে অবস্থিত বড় ভবানীপুরের গোবিন্দবাড়িতে অবস্থিত ব্লাইথ ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েছে। বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স না থাকলেও ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে শুল্ক রেয়াতি সুবিধার আওতায় ১২৩টি ব্যাক টু ব্যাক মাস্টার এলসির মাধ্যমে ৬৭ লাখ ৪০ হাজার ৪১৬ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। যার বিপরীতে ৮ লাখ ৪২ হাজার ৬৬৩ ডলারের রপ্তানি সংঘটিত হয়নি। আর একই সময়ে ওই গ্রাহকের অনুকূলে ৩৫০টি ব্যাক টু ব্যাক এলসি ইস্যু হয়েছে। যার পরিমাণ ৫৫ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ ডলার। এখানে দুই দফার হিসাব একসঙ্গে করে দেখা গেছে, বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৬৩ লাখ ৫০ হাজার ৩৫৩ ডলার বা ৬৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা বন্ধ পাওয়া যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বন্ধ সেই কারখানায় আমদানিকৃত পণ্যের কাঁচামাল এবং তা থেকে প্রস্তুতকৃত পণ্যের কোনো মজুদ পাওয়া যায়নি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংক এলসির মাধ্যমে আমদানির দায়িত্ব নিয়ে থাকে। তবে এ জন্য আইন ও শর্ত মানতে হয়। ব্যাংকের প্রথম ও মৌলিক দায়িত্ব হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের এলসি খোলার আগে তার লাইসেন্স, লাইসেন্স নবায়ন ও মেয়াদ হালনাগাদ আছে কি-না তা যাচাই করা। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কর, ভ্যাট ও ব্যবসা সনদ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জেনে নেওয়া। বন্ডেড ওয়্যারহাউস হলে সে সংক্রান্ত সনদ ও মেয়াদ, কারখানার অবস্থানের খোঁজ নেওয়া ও উৎপাদিত পণ্য নিয়মিত তদারকি করা। ব্যাংকে পেমেন্ট করার আগে অবশ্যই খেয়াল দেখতে হবে এলসির পণ্য দেশে আসছে কিনা, নাকি শুধু শুধু টাকা বিদেশে যাচ্ছে। আর ব্যাংক টাকা দেয় বলে সেটা দেখার দায়িত্ব ব্যাংকেরই। এলসিতে অনিয়ম হলে বা পাচারের মাধ্যমে টাকা বিদেশে গেলে সে দায় ব্যাংক এড়াতে পারে না। পরের দায়িত্ব হলো লাইসেন্সদাতা প্রতিষ্ঠান এনবিআরের। তাদের দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিয়ে কী করছে, তা তদারকি করা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও এলসি খোলার আগে সবকিছু যাচাই করা উচিত। তা না হলে বিতরণ করা ঋণ ফিরে পাওয়া কঠিন। আর ঋণ দেওয়ার পরই তা কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। বড় অনিয়ম হলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা ঠিক হবে না। এতে ব্যাংকের দুর্বলতা ধরা পড়লে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাম্প্রতিককালে তিন ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক নাবিল গ্রুপ ও মেডিগ্রিন নাম অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে বিতরণকৃত ৯ হাজার কোটি টাকার অধিক বিনিয়োগকে সন্দেহজনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। এর মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ১২০ কোটি টাকার বিনিয়োগকেও সন্দেহজনক ঋণ মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
উল্লেখ্য, রপ্তানির জন্য কাঁচামাল ক্রয় ও প্রক্রিয়াজাতকরণে মূল এলসি জামানত রেখে অর্থ সংগ্রহের মধ্যবর্তী পদ্ধতি ব্যাক টু ব্যাক এলসি হিসেবে পরিচিত।