শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৯ অপরাহ্ন

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং কিছু কথা

মো: সিরাজুল ইসলাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৩
  • ১১৪ বার

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্বাধীন দেশ হিসেবে জনগণের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। দেশকে স্বাধীন করতে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি মাত্র ৯ মাসে পাকসেনাদের হটিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এক শ্রেণীর কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে খাদ্য সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের হাত থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে লঙ্গরখানা ও ন্যায্যমূল্যে চাল, ডাল, আটা বিক্রি করার জন্য রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়।

রিলিফ কমিটি কর্তৃক নিয়োজিত ডিলাররা দরিদ্র লোকজনের মধ্যে নামমাত্র চাল, ডাল ও আটা বিক্রি করে। বেশির ভাগ ডিলার চাল, ডাল ও আটা ব্ল্যাকে বিক্রি করে দিত। ফলে দরিদ্র লোকজনের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়। ডিলারদের ন্যক্কারজনক কারসাজির কারণে বেশির ভাগ লোকজনের এক বেলাও খাদ্য জুটত না। ফলে দেশের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নিজ দলের নেতাকর্মীদের অসহযোগিতা ও জাসদের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই অতিষ্ঠ হয়ে যান। সাড়ে তিন বছরের শাসনের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু সংখ্যক বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচানোর জন্য এই মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেন। তারপর অনেক ঘটনা ঘটে গেল।

একই বছর ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ৮১ দিন শাসন করার পর মোশতাকের শাসনের অবসান ঘটে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। তিনি সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন। সেই সময় জিয়াউর রহমান বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দিয়ে নিজের রাষ্ট্রপতির পদ পাকাপোক্ত করে নেন। জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি হয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে সংযোজন করেন। ফলে দৃশ্যত চিরদিনের জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ হয়ে যায়।

সুদীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রধান কাজ ছিল দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা। সেই লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে সংবিধানে সংযোজন করা হয়। তখন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে আর কোনো বাধা রইল না। পরবর্তীতে বিচারকার্য সম্পন্ন করেন। বিচারে খুনিদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এখনো কয়েকজন আসামি বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। বর্তমান সরকার তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। জানামতে, ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আমি আলোকপাত করতে চাই। সেই প্রসঙ্গে আমার মতামত হলো- একই সরকার বার বার ক্ষমতায় আসায় ঘুষ-দুর্নীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, একদিকে নির্বাচন; অন্য দিকে প্রশাসনে ব্যাপক হারে ঘুষ-দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কর্তৃক ঠিকমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না যে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করছে। তাদের লাগাম ঠিকমতো ধরতে না পারলে জিনিসপত্রের দাম ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা বেশির ভাগ মানুষ। এ রকম একটি পরিস্থিতি পার করে এসেছি আমরা দেড় যুগ আগে। শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০০৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের এগিয়ে চলা সারা বিশ্বকে অবাক করেছে। উন্নয়ন মানে, শুধু সেতু, কালভার্ট, রাস্তাঘাট আর বড় বড় অট্টালিকা নয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে বহুমাত্রিক। গ্রাম থেকে শহর, সর্বোচ্চ বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উন্নয়নটা কী বিপুল বিচিত্র। এই কথা সত্যি হয়, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রভৃতি উন্নয়ন দেশের মাইলফলক। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নের কথা স্বীকার করতে অনীহা প্রকাশ করছে।

করোনা মহামারীর রেশ কাটতে না কাটতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বিশ্ব পরিস্থিতিতে মূলত তিনটি কারণে জরুরি বৈদেশিক ঋণ নেয়া বাংলাদেশের জন্য আবশ্যক হয়ে পড়েছে। দেশের জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য যেকোনো শর্তে বৈদেশিক ঋণ নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। প্রথম কারণ হলো- জনগণের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় আমদানি অব্যাহত রাখার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক ঘাটতি। দ্বিতীয় কারণ হলো- চলমান প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার জন্য বৈদেশিক উপকরণাদি সংগ্রহ করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা। তৃতীয়ত, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে ও রফতানি আয় বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন আনুষঙ্গিক অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাদি সংগ্রহ নিশ্চিত করার জন্য এবং দেশের অভ্যন্তরে কর্মরত উচ্চপ্রযুক্তিগত বিদেশী কর্মশক্তির ব্যয়ভার তথা প্রদান করার জন্য; ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা পূরণের জন্য। এই তিনটি কারণেই একের সাথে অন্য কারণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমদানি কমালে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়।

সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সাথে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী, সরকার ইতোমধ্যে তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে। ফলে বাসভাড়াসহ সব পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। দাম বৃদ্ধির বোঝা বহন করতে হয়েছে সাধারণ জনগণকে। তাই জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সব বিরোধী দল আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এ ব্যাপারে এফবিসিআইসহ সব ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলেন, সরকার জ্বালানি খাতে আগে অনেক লাভ করেছে, এখন সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিয়ে আগের মুনাফার সাথে সমন্বয় করতে পারত। কিন্তু সরকার ব্যবসায়ীদের কথায় কর্ণপাত করেনি।

অতীব দুঃখের বিষয়- নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। সরকার দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। ফলে জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। সরকারি দল ও বিরোধী দলের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে সিন্ডিকেট করে দাম বৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছে। ভোক্তা অধিদফতরের কর্মকর্তারা কিছুতেই দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এতে দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। কবে নাগাদ জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে, জনগণ সরকারের কাছে সেই প্রত্যাশা করে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট


নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com