আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় আমদানিকারকরা বলছেন, জটিলতার মধ্যেও যেসব এলসির পণ্য বন্দরে আসছে, ডলার সংকটের কারণে তা খালাস করা যাচ্ছে না। ব্যাংকিং জটিলতায় এলসি খুলতে পারছেন না মধ্যম সারির ব্যবসায়ীরা। ফলে করোনার সময়ের তুলনায় ভোগ্যপণ্য আমদানি অনেকটা কমেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সময়মতো খালাস করতে পারলে এবং আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঘাটতি এলসি ছাড়তে পারলে রমজানে নিত্যপণ্যের কোনো সমস্যা হবে না।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় নিত্যপণ্য বহনকারী আরও দুজাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। এ দুজাহাজে করে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা ৮০ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি রয়েছে। এর ফলে বন্দরে আটকে থাকা জাহাজের সংখ্যা পাঁচটিতে দাঁড়িয়েছে। এসব জাহাজে মোট ১ লাখ ৩৫ হাজার টন পণ্য রয়েছে। এ কারণে রোজার মাস নিয়ে তৈরি হয়েছে আগাম শঙ্কা। আর এ সুযোগে এখন থেকেই দাম বাড়ানো শুরু করেছে একটি অসাধু চক্র।
আমদানিকারকরা বলছেন, ২০২১ তুলনায় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপরিশোধিত চিনির এলসি কমেছে ২৮ ভাগ, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও ছোলার এলসি কমেছে ৪৭ ভাগ এবং খেজুরের এলসি কমেছে ৩০ ভাগ পর্যন্ত।
রমজান মাসে বাজারে স্বস্তি ফেরাতে দুই মাস আগে থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি সরবরাহ নিশ্চিতেও জোর দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৬টি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সহায়তা দিতে বৈদেশিক মুদ্রার একটি অংশ নির্দিষ্ট করে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে রমজানের পণ্য আমদানি এবং খালাসে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এসব পণ্য আমদানি ও খালাসের জন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পরও যদি এলসি খোলার ক্ষেত্রে জটিলতা থাকে তা হলে রমজানে প্রভাব পড়বে।’
রমজানে নিত্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ। এতে বলা হয়, ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানির সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। এতে এলসির অনিশ্চয়তা অনেকটা কমেছে
বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রোজার চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে চিনি আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত ছয়টি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে কোটা সুবিধা দেওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে। কোটা সুবিধায় দেশটি থেকে আমদানি হবে চাল, গম, চিনি, আদা, রসুন ও পেঁয়াজ। চাল, গম ও চিনির মতো তিনটি পণ্যের আমদানি চাহিদা সংশোধন করে নতুন কোটা নির্ধারণে একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সরকার। ওই কমিটি গত দশ বছরে ভারত থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানির পরিমাণ ও যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে এবার আমদানি চাহিদা ঠিক করবে।
জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নূর মোহাম্মদ মাহবুবুল হককে প্রধান করে কমিটিতে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে এ কমিটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। এর পরই সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমদানি চাহিদা নিয়ে ভারতকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হবে।
সম্প্রতি ভারতের দিল্লিতে বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ভোগ্যপণ্যের কোটা সুবিধা চাওয়া হয়। সে সময় বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য প্রতি বছর ৪৫ লাখ টন গম, ২০ লাখ টন চাল, ৭ লাখ টন পেঁয়াজ, ১৫ লাখ টন চিনি, ১.২৫ লাখ টন আদা, ৩০ হাজার টন মসুর ডাল ও ১০ হাজার টন রসুনের কোটা চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এবার চাল, গম ও চিনির মতো তিনপণ্যের চাহিদা কিছুটা কমিয়ে নতুন প্রস্তাব করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রমজানের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানান, আগামী রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। বৈশ্বিক সংকট ও ডলারের দর বৃদ্ধির এ সময়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এর পরও রোজায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এমন সব খাদ্যপণ্য আমদানিতে ডলারের জোগান দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আশা করছি, রমজানের সময় দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক থাকবে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট ভালো।’
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অবস্থা : দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। আর রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ২ লাখ টন। আমদানি করতে হয় ২০ লাখ টন। দেশে চিনির চাহিদাও রয়েছে ২০ লাখ টন। রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় ৩০ হাজার টন। আমদানি করতে হয় ২০ থেকে ২২ লাখ টন। মসুর ডালের চাহিদা ৬ লাখ টন। রমজানে চাহিদা ১ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় ২ দশমিক ২ লাখ টন। আমাদানি করতে হয় ৪ লাখ টন।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন। রমজানে চাহিদা ৪ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় ২৭ দশমিক ৩০ লাখ টন। আর আমদানি করতে হয় ৬-৭ লাখ টন। ছোলার চাহিদা দেড় লাখ টন। রমজানেই প্রয়োজন ১ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় শূন্য দশমিক ৪৬ টন। আমদানি করতে হয় ২ লাখ টন। দেশে বছরে ১ লাখ টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। রমজানেই চাহিদা ৫ হাজার টন।