প্রবাসীদের ওপর খড়গ নামালো বাংলাদেশের রাজউক। সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় বা দেখভালো সংক্রান্ত পাওয়ার অব এটর্নি অধিকার প্রবাসে বসে আর দেয়া যাবে না। কনসু্লেটের সত্যায়নে বিদেশে বসেও তা দেয়া যেত। বাংলাদেশে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের আওতায় থাকা প্লট বা ফ্ল্যাটের জন্য কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে বা আমমোক্তার নিয়োগ বা বাতিলের আগে রাজউকের অনুমোদন নেয়ার একটি নতুন নির্দেশনা কার্যকর করেছে সংস্থাটি। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, প্রাতিষ্ঠানিক প্লট, ফ্ল্যাটের বরাদ্দ গ্রহীতা, লিজ গ্রহীতাদের সকল প্লটের, ফ্ল্যাটের আমমোক্তার নিয়োগ এবং বাতিলের- উভয় ক্ষেত্রেই এটি কার্যকর করা হয়েছে পহেলা মার্চ থেকে। ফলে রাজউকের আওতায় থাকা এ ধরসের প্লট বা ফ্ল্যাটের জন্য কাউকে আমমোক্তার করা হলে সেটি রেজিস্ট্রেশনের আগেই রাজউকের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে করতে হবে। আগে এটি রেজিস্ট্রি অফিসেই করা যেতো। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন ভূমি সংক্রান্ত জালিয়াতি রোধে এটি কার্যকর হবে বলে তারা মনে করছেন। “অনেক প্লট বা ফ্ল্যাটে আমমোক্তার নিয়োগ বা বাতিলের বিষয়টি রাজউককে অবহিত করেন না। ফলে নানা জটিলতা তৈরি হয়। অনুমতি নিয়ে এটা করা হলে জালিয়াতি কমবে বলেই আমরা মনে করি, ”বলছিলেন সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা। তবে তিনি তার নাম না প্রকাশ করার অনুরোধ করেছেন। যদিও অনেকে মনে করছেন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তার দেয়া বা বাতিলের জন্য অনুমোদনের জন্য আবেদন প্রক্রিয়ায় জটিলতা থাকায় নতুন নির্দেশনা বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে। এ ব্যাপারে নিউইয়র্কে আইন প্রাকটিশনার এটর্নি মইন চৌধুরীর দৃষ্টি আর্কষন করা হলে তিনি বলেন, আইনটির বিস্তারিত জানি না। তবে কাগজে যা দেখেছি, তা প্রবাসীদের দুর্ভোগের কারন হয়ে দাড়াঁতে পারে। ভোগান্তি বাড়বে। দেশে গিয়ে পাওয়ার অব এটর্নি দেয়া কঠিন ব্যাপার। অনেক অভিযোগ ও অনিয়মের কারনে হয়তো এসব হচ্ছে। কিন্তু এতে প্রবাসীদের হয়রানী বাড়বে। নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা অফিসিয়ালি এখনও জানি না। জানার পর তা কমিউনিটিকে অবহিত করা হবে। সরকার প্রবাসীদের কোন ধরনের হয়রানী হোক চাইবেন না। নতুন আইনে কোন অসংগতি থাকলে তা সংশোধনে আমরা সুপারিশ করবো। জনগনকে নিয়েতো সরকার ।
নির্দেশনার তথ্য রাজউকের এ সংক্রান্ত অফিস আদেশে বলা হয়েছে আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, প্রাতিষ্ঠানিক প্লট, ফ্ল্যাটের বরাদ্দ গ্রহীতা, লিজ যারা গ্রহণ করবেন তাদের রাজউকের অনুমোদন নিতে হবে।এ নির্দেশনা অনুযায়ী সব প্লট ও ফ্ল্যাটের জন্য আমমোক্তার নিয়োগ বা বাতিলের ক্ষেত্রে রাজউক থেকে আগে অনুমোদন নিয়ে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।রাজউকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন নির্দেশনাটি চলতি মাস থেকেই কার্যকর হয়েছে। ফলে এখন কেউ চাইলেই কাউকে আমমোক্তার করেই জমি বা ফ্ল্যাট অন্য কারও কাছে বিক্রি করতে পারবেন না। আবার একবার কাউকে আম-মোক্তার করা হলে সেটি বাতিল করার জন্যও রাজউকের অনুমতি লাগবে।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তার বিষয়টি কী : পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তার নামা একটি সম্পূর্ণ আইনি দলিল, যার মাধ্যমে একজন আরেকজনের আইনি প্রতিনিধি হিসেবে প্লট বা ফ্ল্যাট ক্রয় বা বিক্রয় করতে পারেন। স্ট্যাম্প অ্যাক্ট – ১৮৯৯ এর ২(২১) উপধারা অনুসারে যে দলিল দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে অপর কোনো ব্যক্তির পক্ষে হাজির হয়ে কার্য সম্পাদন বা কোনো ডিক্রি, রেজিস্ট্রি সম্পাদন তত্ত¡াবধান ইত্যাদি বিষয়ক কার্যক্রম সম্পাদন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়।
অর্থাৎ কোন ব্যক্তিকে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করা অর্থাৎ কোন ব্যক্তিকে অন্য কোন ব্যক্তির পক্ষে কোন কাজ করে দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে ক্ষমতা প্রদান করাই হলো পাওয়ার অব অ্যাটর্নি। তবে কোনো দায়িত্ব বা ক্ষমতা অর্পণের জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তারনামা করতে হলে সেটি লিখিত আকারে করতে হয় এবং এটি একটি আইনগত দলিল। এই দলিলের মাধ্যমে যাকে মোক্তার নিয়োগ করা হলো, তিনি মূল মালিকের পক্ষে কোনো সম্পত্তির দান, বিক্রি, হস্তান্তর, রক্ষণাবেক্ষণ, বন্ধক রাখা এবং খাজনা আদায়ের মতো কাজগুলো করে থাকেন।
সাধারণত মোক্তারনামা দুই প্রকার। একটি হচ্ছে সাধারণ মোক্তারনামা, যাকে আমমোক্তারনামা বলা হয়। আরেকটি হচ্ছে খাসমোক্তারনামা, যা বিশেষ ধরনের।সাধারণত মোক্তারনামায় মোক্তারদাতার পক্ষে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু বিশেষ মোক্তারনামা সম্পাদন করতে হয় নির্দিষ্ট কাজের জন্য। যেসব আমমোক্তারনামা জমিজমা হস্তান্তরের সঙ্গে জড়িত নয়, সেগুলো নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নোটারি করে নিতে হয়। কিন্তু জমিজমা সংক্রান্ত মোক্তারনামা অবশ্যই রেজিস্ট্রি করাতে হবে। না হলে এর আইনগত ভিত্তি থাকে না।
বিদেশে বসবাস বা অবস্থানরত কোনো ব্যক্তি কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে চাইলে দূতাবাসের মাধ্যমে দলিলটি সম্পাদন ও প্রত্যয়ন করে পাঠানোর নিয়ম ছিলো। এখন নতুন নিয়ম অনুযায়ী তাদের এটি করার আগে রাজউকের অনুমোদন নিতে হবে।
জটিলতার আশঙ্কা কেন : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোঃ হাফিজুর রহমান খান বলছেন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি অ্যাক্ট ২০১৫ অনুযায়ী একজনের পক্ষে আরেকজনকে কাজ করার আইনি অধিকার দেয়া হয়। আর রাজউকের নিয়ম হলো তাদের এ ধরনের কাজে অনুমোদন নেয়ার জন্য প্লট বা ফ্ল্যাট মালিককে সশরীরে এসে আবেদন করতে হয়। তাছাড়া রাজউক আইন অনুযায়ী পাওয়ার অব অ্যাটর্নি অনুমোদন ছাড়া দেয়া বা বাতিল করা হলে সেটি আইনসিদ্ধ হবে না।
“কিন্তু প্রশ্ন হলো এর বাস্তবিক একটা দিক আছে। ধরুন যিনি বিদেশে থেকে সম্পদ ক্রয় বা বিক্রয় করতে চান। কিংবা অনেক অসুস্থ বয়স্ক ব্যক্তি সম্পদ বিক্রি বা ক্রয় করবেন। তাদের পক্ষে রাজউকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এ ধরসের অনুমোদনের জন্য আবেদন করা অসম্ভব। ফলে নতুন করে জটিলতা তৈরি ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আইনজীবী মোঃ হাফিজুর রহমান খান বলেন, অনেকেই বিদেশে থাকেন যাদের বাবা হয়তো দেশে থাকেন। বাবা মারা গেলে বিদেশে থাকা সন্তানদের অনেকে দেশে এসব সম্পদ রাখতে চান না। এখন নতুন নিয়ম তাদের বিপাকে ফেলবে কারণ শুধু পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেয়ার জন্যই তাদের সশরীরে আসতে হতে পারে। যদিও এর অন্য আরেকটি দিকও আছে বলে মনে করেন তিনি।“পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে অনেক জালিয়াতির ঘটনাও ঘটছে। এটিও সত্যি। ভুয়া আম-মোক্তার তৈরি করে অনেকে এমন কাজ করে। তাই কাকে আম-মোক্তার করা হচ্ছে সেটি রাজউককে আগে জানালে জালিয়াতির সুযোগ কমতে পারে। তাই বলা যায় নতুন নিয়মটি একদিকে জটিলতাও বাড়াতে পারে আবার জালিয়াতি কমাতেও ভূমিকা রাখতে পারে, ”বলছিলেন হাফিজুর রহমান খান। (বিবিসি প্রতিবেদন/মনোয়ারুল ইসলাম)