বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৩০ অপরাহ্ন

বন্দর আধুনিকায়নের ব্যয় তীরের পেছনেই

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
  • ২৭১ বার

নদীবন্দর আধুনিকায়ন হবে। ভারতের সাথে সড়কপথে এই বন্দরটি ব্যবহার করা হয়। আনুষঙ্গিক সুবিধাও বাড়ানো হবে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। কিন্তু এই আধুনিকায়নের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তার অর্ধেকই যাচ্ছে নদীর তীর রক্ষার পেছনে। আর এই ব্যয়ও প্রতি কিলোমিটারে অন্যান্য নদীর চেয়ে অনেক বেশি।

নদীর তীর সংরক্ষণকাজের ব্যয় নিয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি চলছে। পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়ায় আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ নদীবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার তীররক্ষায় খরচ পড়ছে ৮৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে মাথাপিছু খরচ ধরা হয়েছে ৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনে এই তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে।

একনেকে অনুমোদিত দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া নদীবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পটির প্রস্তাবনার তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত এই ঘাটটি দিয়ে নৌপথে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীবাহী ও মালবাহী পরিবহন পারাপার হয়ে থাকে। এই ফেরিঘাটটি প্রতিষ্ঠা করা জয় আনুমানিক ১৯৪০ থেকে ৪৫ সালে।

রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র দেশের সাথে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী পদ্মার দুই পাড়ের ঘাটগুলোর অনুন্নত অবকাঠামো, নদীভাঙনে ঘাটের আয়তন কমা, ফেরি স্বল্পতা, যানবাহনের আধিক্য, নদীতে নাব্যতা সঙ্কট ও সংযোগ সড়কের বেহাল দশাসহ বিভিন্ন কারণে উভয় পাড়ে প্রতিদিন মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে শত শত গাড়ি।

বিশেষ করে দুই ঈদসহ অন্যান্য উৎসবে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে পণ্য পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এটি নিত্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব ফেলে। এক হাজার ৩৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে তিন বছরে।

জানা গেছে, ২০০১-২০০২ সালে এটা পাটুরিয়াতে স্থানান্তরিত হয়। এই স্থানান্তরের প্রধান কারণ ছিল আরিচা এলাকায় নদীতে প্রচুর পলি পড়ায় পানির গভীরতা কমে যাওয়া। এখন পাটুরিয়াতে চারটি ফেরিঘাট, একটি লঞ্চঘাট, তিনটি টার্মিনাল, ১৯টি ফেরি, ৬০ থেকে ৯০টি লঞ্চ রয়েছে। নদীর অপরাংশে দৌলতদিয়া ঘাট।

প্রকল্পের মাধ্যমে বহুতল সুবিধাসহ টার্মিনাল বিল্ডিং এবং অন্যান্য স্থাপনাদি নির্মাণ, ড্রেজিং কাজ ৪৫ লাখ ঘনমিটার, ভূমি উন্নয়ন, পার্কিং ইয়ার্ড, ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ, সীমানা প্রাচীর, স্টিল জেটি নির্মাণ, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া এলাকায় নদীশাসন কাজ ৮ কিলোমিটার আরসিসি রোড নির্মাণ এবং স্টিল স্পাড ইত্যাদি।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের আওতায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের আধুনিকায়নে দুই পাশেই আধুনিক সুবিধাসংবলিত বহুতল টার্মিনাল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হবে। নতুন ফেরিঘাট নির্মাণ, আরসিসি পার্কিং ইয়ার্ড, অভ্যন্তরীণ রোড এবং ফেরিঘাট অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ করা হবে। ফেন্সি ওয়ালসহ ফেরিঘাটের কাছে প্রটেকশন ওয়ালের মাধ্যমে নদীর তীরও শক্তভাবে রক্ষা করা হবে। স্পাডসহ ফেরিঘাটে স্টিল জেটি নির্মাণ করা হবে।

এগুলো ঘাট থেকে নদীর দিকে আড়াআড়ি থাকবে, যাতে শীত-বর্ষা সবসময় ফেরি ভিড়তে পারে। উভয় পাশেই উন্নতমানের ফোর লেন সংযোগ সড়ক থাকবে। ঘাটে নৌযানগুলোর আগমন-নির্গমন ও ফেরিতে পারাপারের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী এবং পরিবহনগুলোর জন্যও গড়ে তোলা হবে উন্নত টার্মিনাল ও পার্কিং সুবিধা। উন্নত বিশ্বের ঘাটগুলোর সুযোগ-সুবিধার আদলে প্রকল্পটি পরিচালনা করা হবে।

প্রকল্প ব্যয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পে তীর রক্ষায় ব্যয় হবে ৬৮০ কোটি টাকা। মোট ৮ কিলোমিটার তীর রক্ষার জন্য কাজ করা হবে। এখানে পাটুরিয়ায়তে দুই কিলোমিটার এবং দৌলতদিয়াতে ছয় কিলোমিটার। ফলে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৮৫ কোটি টাকা। যেখানে সিলেটের কালকিনি-কুশিয়ারা নদীর তীর সংরক্ষণ চলমান প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে তীর সংরক্ষণ খরচ হচ্ছে ১১ কোটি ৮৮ লাখ ৪২ হাজার টাকা।

একইভাবে হবিগঞ্জের বিবিয়ানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কুশিয়ারা নদীর তীর সংরক্ষণে কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এখানে মোট ৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা। নোয়াখালীর মুসাপুরে ৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ শ’ কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এখানে কিলোমিটারে ব্যয় হবে ২২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার পদ্মার শাখা নদীর ডান তীরের ভাঙন থেকে নওয়াপাড়া এলাকা এবং পদ্মা নদীর বাম তীরের ভাঙন থেকে চরআত্রা এলাকা রক্ষা করার জন্য ৫৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প হয়েছে। যেখানে নদীর ৮ দশমিক ৭০ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণে মোট ব্যয় ধরা হয় ৪৬৮ কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা। ফলে এখানে প্রতি কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ করতেই খরচ হবে ৫৩ কোটি ৮১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। একই মন্ত্রণালয়ের অপর প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে তীর সংরক্ষণ কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ কোটি ২৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।

আর প্রকল্পটি হলো, কুড়িগ্রাম জেলার কুড়িগ্রাম সড়র উপজেলা, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলাধীন ধরলা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ বাম ও ডানতীর সংরক্ষণ এবং ড্রেজিং। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ৬৯৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এই দুই প্রকল্পে তীর সংরক্ষণ কাজের ব্যবধান ৩২ কোটি ৫৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা।

জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএ এ বছর দৌলতদিয়ায় ফেরিঘাট রক্ষায় ৫২ হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেছে। এ জন্য ব্যয় হয়েছে তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড গত জুনে ৪২ হাজার ও অক্টোবরে এক লাখ ১০ হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে যার ব্যয় হয়েছে সাত কোটি টাকা। ওই এলাকায় নদীতীর রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত ১৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

অনুমোদিত বন্দর আধুনিকায়ন এই প্রকল্পে ১০ জনকে বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো হবে। যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। ফলে মাথাপিছু বিদেশখরচ হবে ৬ লাখ টাকা। এই ব্যয় প্রথমে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে ৬০ লাখ টাকায় কমিয়ে আনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে পানিসম্পদ খাতে নদীতীর সংরক্ষণ ও ড্রেজিং কাজের ব্যয়। এসব প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েরই আপত্তি থাকে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই আপত্তি ধোপে টেকে না। অনুমোদনও পেয়ে যাচ্ছে। আবার নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প সমাপ্ত না হওয়ার পর ব্যয়ও বাড়ছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সেচ উইংয়ের যুগ্ম-প্রধান বলছেন, নদীর তীর সংরক্ষণের কাজে চেইনেজ, স্থাপন, নকশা ও এ কাজে ব্যবহৃত মালামালের বিস্তারিত বিবরণ প্রকল্প প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয় না। এসব খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা উচিত। প্রতিটি নদীর তীর সংরক্ষণে বেশির ভাগই একই ধরনের মালামাল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ব্যয়ের ব্যবধান মাত্রাতিরিক্ত। সমজাতীয় প্রকল্পের তুলনায় প্রতি কিলোমিটারে বা মিটারে এই ব্যয় অত্যধিক। পরামর্শক খাতে প্রায় আট কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখানে নদীর তীর সংরক্ষণ সংক্রান্ত ডিজাইন ও সুপারভিশন কাজের ব্যয় প্রাক্কলনকে বাদ দেয়া দরকার। প্রকল্প প্রস্তাবনায় প্রথমে ৩০ কোটি টাকা রাখা হয় দরজা পার্টিশান নির্মাণের জন্য।

কিন্তু কমিশনের আপত্তিতে সেটা কমিয়ে মাত্র ৫০ লাখ টাকায় আনা হয়। ব্যয়ে প্রাক্কলনে মন্ত্রণালয়গুলো অস্বাভাবিক প্রাক্কলন করে। যার কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রকল্পে বিভিন্ন খাত থাকার পরও অপ্রত্যাশিত খাত নামে একটা অর্থ থোক রাখা হয়। কিন্তু এটাকে বাদ দেয়ার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com