কারাগারে অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বিএনপি এখন তাদের নেত্রীর মুক্তি নিয়ে আর কোনো রাজনীতির সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতী নয়। দলটির নীতিনির্ধারকদের একমাত্র অগ্রাধিকার তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে সবার আগে জরুরি তার মুক্তি, সেটি জামিনে হোক কিংবা সরকারের নির্বাহী আদেশে হোক।
দলটির নেতাদের অভিমত, সুচিকিৎসার অভাবে যেখানে বেগম জিয়ার জীবন বিপন্ন হওয়ার পথে, সেখানে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। সরকার তার মুক্তি ইস্যুতে ‘প্যারোল’ বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করতে চাইলেও চিকিৎসা প্রশ্নে বিএনপি সেটি আমলে নিচ্ছে না। আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনের চেষ্টা চলছে। আদালত আবারো জামিন নাকচ করে দিলে বেগম জিয়া কিংবা তার পরিবার যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটিই দল মেনে নেবে। প্যারোল নিয়ে অতীতে বর্তমান সরকারপ্রধানসহ অনেকেই দেশের বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন, সে বিষয়টিকেও অনেকে সামনে এনে নতুনভাবে পর্যালোচনা করছেন।
দুই মাস আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ খারিজ করে দেয়ার পর আগামী রোববার আবারো জামিন নিয়ে শুনানি হবে। আইনজীবীদের প্রত্যাশা, তিনি এবার জামিন পাবেন। জামিন আবেদনে এবার উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এ দিকে আজ ২১ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়ার সাথে দেখা করার জন্য আবেদন করেছেন পরিবারের সদস্যরা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দেখা করার অনুমতি পাওয়ার খবর জানা যায়নি। তবে জামিন শুনানির আগে এই সাক্ষাৎ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকেই বলেছেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই বেগম জিয়ার কারামুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির ভেতরে আলোচনা আছে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে চান। এ নিয়ে বিএনপি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে পর্দার অন্তরালে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বেগম জিয়া চান জামিনে মুক্তি, প্যারোলে মুক্তি নিতে তিনি আগ্রহী নন।
জানা গেছে, বেগম জিয়া দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার নিজস্ব মতামতের জায়গায় প্রভাব ফেলেছে পরিবারের সিদ্ধান্তও। পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়াকে যেকোনো মূল্যে কারামুক্ত করে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চান। এ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি নিয়েও তাদের আপত্তি নেই। তার চিকিৎসার ব্যাপারে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ইতিবাচক। মায়ের চিকিৎসাকেই তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তার পরামর্শেই পরিবারের সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন।
বিএনপি নেতাদের মতে, খালেদা জিয়ার মুক্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও সরকারের সিগন্যাল ছাড়া কিছুই করবে না। এমন পরিস্থিতিতে আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে কিভাবে তার জামিন পাওয়া যায় সেই চেষ্টাই চলছে। পর্দার আড়ালে সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির সাথে বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতা ও পরিবারের সদস্যদের আলোচনা চলছে। আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিরও চেষ্টা করছে দলটি।
খালেদা জিয়ার মুক্তির অংশ হিসেবে পরিবারের পক্ষ থেকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে। দিন দশেক আগে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর এ আবেদন করেন। এতে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার দ্রুত অবনতিশীল স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো অপূরণীয় ক্ষতি এড়াতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বিদেশী হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন। তার পরিবার ব্যয় বহন করবে এবং তাদের দায়িত্বে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়ে এ আবেদন করা হয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ড যেন খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারকে সুপারিশ করে। এ আবেদন করার পর পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। খালেদা জিয়ার সেজো বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, উন্নত চিকিৎসায় মুক্তির জন্য সরকারের প্রতি মানবিক আবেদন জানিয়েছেন। শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় মানবিক দিকটা বিবেচনা করে তাকে মুক্তি বা জামিন দেয়া উচিত সরকারের।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, জামিন ছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারায়, অর্থাৎ দণ্ড স্থগিত করে সরকার চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনকে মুক্তি দিতে পারে। এটা শুধু সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপার।
জানা গেছে, পরিবার এবং দলের একটি অংশ যেকোনো মূল্যে তাকে কারামুক্ত করে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চাচ্ছেন। এ েেত্র প্যারোলে মুক্তি নিয়েও তাদের আপত্তি নেই। খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন এবং জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, প্রথমে জীবন। নেত্রীর চিকিৎসা প্রয়োজন। বেঁচে থাকলে তার সুযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে আবারো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। কিন্তু কোনো অঘটন ঘটলে দল আরও বিপর্যয়ে পড়বে। দুই বছর জেল খেটে আপস না করে আপসহীন চরিত্রের পরীক্ষায় বিএনপি নেত্রী আবারো উত্তীর্ণ হয়েছেন। ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্রের কারণেই খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন না, এই বিষয়টি জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন দলের সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎ এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামে আবারো ভূমিকা রাখতে এবার প্যারোল চাইলে আপস করেছেন এমনটা বলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে প্যারোলের চেষ্টা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই নেতা আরও বলেন, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে প্যারোলে মুক্তির ইতিহাস অনেক বড় রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। যদি এই কৌশল মঙ্গলের জন্য হয় তা হলে গ্রহণে দোষ কোথায়।
কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করতে তাকে ফোন করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে পর্দার আড়ালের তৎপরতা সামনে চলে আসে। যদিও এই ফোনের বিষয়ে মির্জা ফখরুল স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মির্জা ফখরুল প্যারোলের জন্য ওবায়দুল কাদেরকে অনুরোধ করেননি। তিনি খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তপে কামনা করেছেন তিনি। মির্জা ফখরুল এও বলেছেন, চেয়ারপারসনের মামলাটি রাজনৈতিক। তাই তার মুক্তির বিষয়টিও রাজনৈতিকভাবেই হতে পারে।