বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০১:২৫ অপরাহ্ন

কেন যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে চীনের সাথে গাঁটছড়া বাঁধছে সৌদি আরব

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩
  • ৩৪ বার

মধ্যপ্রাচ্যে গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নাটকীয় এক ঘটনা ঘটে গেছে। সাত বছর আগে ভেঙে পড়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে অঞ্চলের সবচেয়ে দুই প্রভাবশালী বৈরী দেশ সৌদি আরব ও ইরান।

বিস্ময়কর যেটা তা হলো এই সম্পর্ক জুড়তে মধ্যস্থতা করেছে সৌদি আরবের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরঞ্চ বর্তমানে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর প্রতিপক্ষ– চীন।

মার্চের ১০ তারিখে বেইজিংয়ে সৌদি ও ইরানের কর্মকর্তাদের পাশে নিয়ে শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ওয়াং ই এই বোঝাপড়ার কথা ঘোষণা করেন। তারপর, দ্রুতগতিতে ঘটনা গড়াচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সল বিন ফারহান এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আব্দুল্লাহিয়ানের মধ্যে এক বৈঠক থেকে দুই মাসের মধ্যে দূতাবাস খোলা এবং তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে যাত্রী বিমান চলাচলের ঘোষণা দেয়া হয়।

এমনকি, ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি সৌদি আরব সফরের জন্য বাদশাহ সালমানের একটি আমন্ত্রণও গ্রহণ করেছেন বলে ইরানি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

‘মূল সমস্য বিন সালমানের সাথে বাইডেনের’
যে দেশটিকে ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো বোঝাপড়া, মীমাংসা অসম্ভব বলে মনে করা হতো, সেই আমেরিকা এই পুরো প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিত।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি যে দ্রুত কমছে ইরান-সৌদি মীমাংসা চুক্তিকে তার জলজ্যান্ত একটি উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

এমন কথাও অনেক বিশ্লেষক বলছেন, সৌদিরা আট দশক পর শেষ পর্যন্ত আমেরিকার একচ্ছত্র প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ নিয়েছে।

লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক সাদি হামদি অবশ্য মনে করেন এখনই এমন উপসংহার টানা ঠিক হবে না।

তিনি বলেন, সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার যে দূরত্ব এখন দেখা যাচ্ছে সেটা যতটা না দুই দেশের মধ্যে, তার চেয়ে বেশি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যে।

হামদি বলেন, ‘মূল সমস্যা বিন সালমানের সাথে বাইডেন এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সম্পর্ক। কিন্তু আপনি জানেন না যে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি একইরকম থাকবে কিনা।’

তার মতে, সৌদি আরব যে বোঝাপড়া ইরানের সাথে করেছে তা তার দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কিছুটা বাধ্য হয়ে ‘সন্ধি করার মতো।’

হামদি বলেন, তেল নির্ভর অর্থনীতির বিকল্প ‘ভিশন টুয়েন্টি থার্টি’ নামে পরিচিত যে উন্নয়ন কর্মসূচি এখন যুবরাজ বিন সালমানের ধ্যান-জ্ঞান তাকে বাঁচাতে তার এই আপস। কারণ ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে গত কয়েক বছরে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এতটাই হুমকিতে ফেলেছে যে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ভয় পাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘গত ছয় বছরে তার ঐ উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনায় পশ্চিমাদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ তিনি পাননি। ফলে ইরানের সাথে সন্ধি করা ছাড়া তার উপায় ছিল না।;

এটা ঠিক যে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা, বিশেষ করে ইয়েমেনের হুতি মিলিশিয়ারা, গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন দিয়ে সৌদি আরবের বিভিন্ন তেলের স্থাপনাগুলো টার্গেট করছিল তা রিয়াদের জন্য চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । ২০১৯ সালে তাদের সবচেয়ে বড় তেলের স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সৌদিদের প্রচণ্ড ভীত করে তুলেছিল।

চীনের প্রবেশ
ঐ ঘটনার পর থেকেই আমেরিকার ওপর ভরসা করে না থেকে নিজেরাই ইরানের সাথে বোঝাপড়া-মীমাংসার প্রক্রিয়া শুরু করে সৌদি আরব। ইরাকের মাধ্যমে তেহরানের সাথে যোগাযোগ শুরু করে তারা।

পরে, গত ডিসেম্বরে শি জিনপিং রিয়াদ সফরে গেলে সে সময় যুবরাজ বিন সালমান ইরানের সাথে সম্পর্ক নিয়ে তার সাহায্য চান বলে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন মিডিয়ায় পরে খবর হয়।

তবে তারপরও সৌদি আরব এখনও চীনকে আমেরিকার বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে তা মানতে রাজি নন সাদি হামদি। তার মতে, সাময়িক স্বার্থ হাসিলের কৌশল এটি সৌদি আরবের।

তিনি বলেন, ‘সৌদিরা জানে যে চীন আমেরিকার প্রভাব বলয়ে হানা দিতে চায়। সুতরাং যুবরাজ বিন সালমান আশা করছেন চীনকে কূটনৈতিক সাফল্যের কিছু পুরস্কার দিয়ে তাদের কাছ থেকে কিছু বিনিয়োগ হয়ত আনা যাবে। সেইসাথে আমেরিকানদেরও কিছুটা ঈর্ষান্বিত করা সম্ভব হবে।’

তিনি বলেন, ‘চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে এখনও বড় কোনো অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা চুক্তি হয়নি। অধিকাংশই এমওইউ অর্থাৎ ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।’

হামদির মতে, সৌদি যুবরাজ এখন যেটা করছেন সেটা তার ‘প্ল্যান বি’।

তিনি বলেন, ‘কারণ যে মডেলে তিনি তার দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সামাজিক সংস্কারের কাঠামো গড়তে চাইছেন তা একেবারেই পশ্চিমা ধাঁচের। প্রযুক্তি পুরোপুরি পশ্চিমা।’

এটা ঠিক যে সৌদি আরব এবং আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক যে চাপে পড়েছে তা স্পষ্ট হতে শুরু করে হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে। মানবাধিকার নিয়ে যুবরাজ সালমানকে বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করতে ছাড়েননি বাইডেন। একঘরে করার হুমকি দিয়েছেন।

কিন্তু অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যে যে পরিবর্তন হচ্ছে সৌদি আরব এবং আমেরিকার সম্পর্কে দূরত্ব তারই পরিণতি। তার জেরেই সৌদি আরবের মত দেশ আমেরিকাকে অন্ধকারে রেখে এমন গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ নিচ্ছে বা নেওয়ার সাহস দেখাচ্ছে।

‘বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দেখছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর বহুদিন ধরে হুকুমজারি চালিয়ে আসছে। সেনা-ঘাঁটি বসিয়ে রাখছে। অহেতুক তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে। তারা এখন আর এসব পছন্দ করছে না। সার্বভৌমত্ব নিয়ে তারা সোচ্চার হচ্ছে, বিকল্প খুঁজছে,’ বলছেন কুয়ালালামপুরে মালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী ।

অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না গলানোর নীতির কারণে চীনকে মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশ বিকল্প হিসাবে দেখতে শুরু করেছে বলে মনে করেন ড. আলী।

তার মতে, ‘তারা মনস্তাত্বিকভাবে এখন আমেরিকার ওপর তাদের দীর্ঘদিনের নির্ভরশীলতা কমাতে উন্মুখ । বিকল্প হিসাবে তারা দেখছে আরেকটি শক্তিধর দেশ উঠে দাঁড়িয়েছে যারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাথা গলায় না, এবং মাথা গলানোর তীব্র বিরোধিতা করছে।।’

আমেরিকা সরে আসছে
তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, চীনকে এক নম্বর ভূ-রাজনৈতিক শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে তাদেরকে কোণঠাসা করতে গিয়ে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের নজর অনেকটাই সরিয়ে নিয়েছে। আর তার ফলেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এ ধরনের অভাবনীয় পরিবর্তনের লক্ষণ চোখে পড়ছে।

‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত সরে আসছে। কারণ তাদের দৃষ্টি এখন এশিয়ার দিকে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এখন অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনীতির ভরকেন্দ্র। এখানেই যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যৎ দেখছে,’ বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।

বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকার এই চিন্তাধারার প্রকাশ গতি পেয়েছে।

সেইসাথে, মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর আমেরিকার নির্ভরতা দ্রুত কমার কারণে অঞ্চলের গুরুত্ব আমেরিকার কাছে আগের মত নেই। তাছাড়া, ইউক্রেন যুদ্ধ আমেরিকার মনোযোগ এবং সম্পদের ওপর এতটাই চাপ তৈরি করেছে যে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাদের বাড়তি দৃষ্টি দেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ফলে, আমেরিকার নতুন এই ভূ-রাজনৈতিক কৌশল অদূর ভবিষ্যতে বদলাবে সেই সম্ভাবনা দেখছেন না ড. রীয়াজ।

তার মতে, ‘চীন যতই মধ্যপ্রাচ্যে ঢোকার চেষ্টা করুক তাতে আমেরিকা খুব বেশি বিচলিত হবে বলে আমি মনে করিনা। তার চেয়ে পাশে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে অর্থাৎ ঘরের পাশে চীনকে ব্যতিব্যস্ত রাখার পথেই আমেরিকা থাকবে।’

বিকল্প হতে পারবে চীন?
কিন্তু চীনের পক্ষে কি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বিকল্প হওয়া সম্ভব? আমেরিকার মতো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সামরিক ঘাঁটি তৈরির ক্ষমতা বা ইচ্ছা কি চীনের রয়েছে? মধ্যপ্রাচ্যে? তাদের লক্ষ্য ঠিক কী?

ড. মাহমুদ আলী মনে করেন সমর শক্তিতে তারা আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইছে না এবং সেটা তারা এখন পারবেও না।

তিনি বলেন, ‘চীন এখন অর্থনীতি এবং কূটনীতি কাজে লাগিয়ে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশের নৈকট্য লাভের চেষ্টা করছে। সংঘাতে না জড়িয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খর্ব করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

এবং, ড. আলী বলেন, চীন কিছু দেশকে বোঝাতে সম্ভব হয়েছে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প কূটনৈতিক মিত্র হতে পারে।

আর সে কারণেই হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের দুই শীর্ষ প্রভাবশালী প্রতিপক্ষ ইরান এবং সৌদি আরব তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার জন্য চীনের দ্বারস্থ হয়েছে।

সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি কতদিন টিকবে তা নিয়ে এখনও বহু বিশ্লেষক সন্দিহান কারণ এই দুই বৈরি দেশের রেষারেষির পেছনের মৌলিক কারণগুলো সহসা দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম।

কিন্তু তারপরও সন্দেহ নেই, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে এটি একটি মোড়-ঘোরানো পর্ব। কারণ, বহুদিন পর ঐ অঞ্চলের এত বড় একটি ঘটনায় আমেরিকা অনুপস্থিত, আর মঞ্চের কেন্দ্রে চীন।
সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com