ঢাকার মিরপুর রোডে ২০১৯ সালে গ্যাস লাইনে লিকেজ হওয়ার কারণে একটি বাস এবং একটি পিকআপে আগুন লেগে যায়।
সোমবার রাতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক গ্যাস লিক হওয়ার ঘটনায় যেকোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সোমবার ঢাকার খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী, বেইলি রোড, তেজগাঁও, মহাখালী, লালবাগ, ইস্কাটন, বাড্ডা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, হাজারীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের ঝাঁঝাল গন্ধ পেলে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
তিতাস কর্তৃপক্ষ বলেছে, ঈদের ছুটিতে গ্যাসের চাহিদা কমে যাওয়ায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে চাপ বেড়ে যায়। যার ফলে বিভিন্ন লিকেজ দিয়ে গ্যাস বের হতে থাকে। পরে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দেয়া হলে রাতের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। তাই আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও একসাথে এতোগুলো এলাকায় গ্যাস লিক হওয়ার ঘটনায় যেকোনো মুহূর্তে আগুনের সংস্পর্শে বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
এই গ্যাস জনস্বাস্থ্যের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে তারা জানিয়েছেন।
গ্যাস লিক হওয়ার পেছনে তারা মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন প্রতিস্থাপন বা সংস্কার না করা, অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে না পারা, গ্যাসের চাপ ও লিকেজ শনাক্তে স্বয়ংক্রিয় কোনো ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করছেন।
গ্যাসের গন্ধে আতঙ্ক, জরুরি নম্বরে যোগাযোগ
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার সন্ধ্যা থেকেই তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাসের গন্ধ পাওয়ার অভিযোগ পেয়েছেন।
অনেকে আবার ৯৯৯ এ ফোন দিয়েও সাহায্য চেয়েছেন। কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়ে তিতাসের জরুরি নম্বরে ফোন দিলেও সেখানে কোনো সাড়া মেলেনি বলে অভিযোগ করেন।
আবার ইস্কাটন এলাকায় পথে পথে মাইকিং করে এবং কোনো কোনো এলাকার মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে গ্যাসের চুলা বন্ধ রাখা এবং দেশলাই না জ্বালানোর আহ্বানও জানানো হয়।
খিলগাঁও তালতলা এলাকার বাসিন্দা রিফাত হাসান সোমবার রাত সাড়ে ১০টা থেকেই তীব্র গ্যাসের গন্ধ পান।
তিনি বলেন, ‘রাস্তায় খোলা জায়গায় ঝাঁঝালো গ্যাসের গন্ধ। নিচে কতো মানুষ সিগারেট খায়, আগুন জ্বালায়, এখানে দুর্ঘটনা ঘটা তো বিষয়ই না। ভয়ে ঘুমাতে পারছিলাম না। আমাদের বিল্ডিংয়ের অনেকে নিচে নেমে আসে।’
পরে তিনি দেখতে পান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে বিভিন্ন গ্যাসের লাইন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন।
কাঠাল বাগান এলাকার বাসিন্দা অঙ্গন কর্মকার তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘ভয় লাগছে। আমাদের পুরো এলাকা গ্যাসের গন্ধে ভরে গেছে। রাস্তা থেকে গ্যাসের গন্ধ উঠছে। কেউ চুলা, ম্যাচ এ ধরণের কোনো আগুন জ্বালাবেন না।’
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তার ভ্যারিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টে নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘ঢাকার গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’
ওভার ফ্লো থেকে গ্যাস ছড়াচ্ছে
এর আগে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের বরাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় মধ্যরাতে এক বিশেষ ঘোষণায় বলা হয় ‘ঈদে শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায়, সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় (ওভার-ফ্লো) গন্ধ বাইরে আসছে। তিতাসের জরুরি ও টেকনিক্যাল টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ।’
মঙ্গলবার ঢাকায় গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ গণমাধ্যমকে জানান, গ্যাসের সঙ্গে ওডোরেন্ট মেশানো ফলে এর গন্ধ পেয়ে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
তবে অভিযোগ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিতাসের ১০টি জরুরি টিম ওইসব এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে এবং কোথাও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কারণ আছে কিনা বা কোনো বিপদ হতে পারে কিনা তা খতিয়ে দেখেছে বলে তিনি জানান।
যেসব এলাকা থেকে অভিযোগ এসেছে সেগুলো খতিয়ে দেখে তারা বুঝতে পেরেছেন যে নরসিংদী-ডেমরার সঞ্চালন লাইন থেকেই এই গ্যাস লিক হচ্ছে।
পরে ঢাকায় যেসব পয়েন্ট থেকে গ্যাসের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেখানে গ্যাসে চাপ কিছুটা কমিয়ে দিলে এক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয় বলে জানান হারুনুর রশীদ।
বর্তমানে ঢাকা শহরের গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক আছে এবং জনগণকে স্বাচ্ছন্দে গ্যাসের চুলা জ্বালানোর পরামর্শ দিয়েছে তিতাস।
মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন
ঢাকা ও এর আশপাশে নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর এবং কিশোরগঞ্জে মূলত তিতাসের পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
এসব পাইপলাইনের প্রায় ৬০ শতাংশেরই মেয়াদ ২০ বছর আগেই পেরিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারপরও তিতাস বা সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই বলে তারা হতাশা প্রকাশ করেন।
তিতাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। তবে তারা বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যায় ১৯৬৮ সাল থেকে। সবচেয়ে বেশি গ্যাসের লাইন বসানো হয়েছে ৮০ ও ৯০ এর দশকে।
সে হিসেবে তিতাসের পাইপগুলোর বয়স এরইমধ্যে ৩০ থেকে ৫৫ বছরের পুরোন হয়ে গিয়েছে।
সত্তরের দশকে বসানো পাইপলাইনগুলোর টেকনিক্যাল লাইফ ধরা হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ বছর। এই সময়ের মধ্যেই পাইপগুলো পুরোপুরি বদলে ফেলার কথা।
কিন্তু বদলানো দূরের কথা কোনো মেরামতও করা হচ্ছে না বলে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন।
তার মতে, আজও মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন ব্যবহারের কারণে গ্যাসের সরবরাহ লাইনে, না হলে এর সংযোগস্থলে ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে।
আবার লিকেজ না থাকলেও পুরোন পাইপলাইন বিস্ফোরণের আশঙ্কা ছিল বলে জানান তিনি।
‘প্রত্যেকটা পাইপলাইনের গ্যাস সঞ্চালনের ক্যাপাসিটি থাকে। একটা নির্দিষ্ট চাপের গ্যাস তারা নিতে পারে। কিন্তু সেই চাপের সীমা অতিক্রম হলে পুরো পাইপলাইন আগুন ছাড়াই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। মাটির ওপরে আধুনিক লাইনে এই ঝুঁকি কম। মাটির নিচে লাইন হলে ঝুঁকি আরো বেশি। কারণ গ্যাসগুলো বের হওয়া জায়গা পায় না।’
গ্যাসের চাহিদা কমে গেলে গ্যাসের চাপ বেড়ে সেটা লিক হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় রাস্তাঘাটে গ্যাসের কারণে দুর্ঘটনা ঘটার মতো, মানুষ মারা যাওয়ার মতো বা বড় আগুন ধরার মতো কোনো অবস্থা নাই। কোনো দিন হবে না। গ্যাসের চাপ বেড়ে গেলে কিছু লিক হতে পারে, পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিছু গ্যাস বেরিয়ে যেতে পারে।’
পাইপলাইনে ছিদ্র ও ক্ষয়
তিতাসের সবশেষ জরিপ অনুসারে, তাদের মোট পাইপলাইন রয়েছে ১৩ হাজার ৩২০ কিলোমিটার জুড়ে। এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রয়েছে ঢাকা মহানগরীতে।
গত অর্থবছর ঢাকার এক হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মান পরীক্ষা করে ৪৫৯টি ছিদ্র পাওয়ার কথা জানায় তিতাস। পরে সেগুলো মেরামত করা হয়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো পাইপলাইন নিয়ে জরিপ করা হলে আরো অনেক ছিদ্র পাওয়া যাবে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে একটি মসজিদে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের পর গ্যাস বিতরণ লাইনে এক হাজার ৬২২টি ছিদ্র শনাক্ত করার কথা জানিয়েছিল তিতাস। পরে ওইসব ছিদ্রও মেরামত করা হয়।
গত অর্থবছরে তিতাসের জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যত অভিযোগ আসে তার মধ্যে গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্রের ঘটনা নিয়ে অভিযোগ ছিল চার হাজার ৮৯১টি।
ঢাকার বেশিরভাগ গ্যাসের লাইন মাটির নিচ থেকে টানা হয়। গ্যাসের ধাতব পাইপগুলো সময়ের সাথে সাথে ক্ষয় হতে শুরু করে।
মাটির চাপ, তাপ, ক্ষার, লবণ, ঝড়-বৃষ্টি, সেইসাথে নানা ধরণের আঘাতের কারণে পাইপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় মরিচা পড়ে লিকেজ দেখা দেয় বলে জানান ইকবাল হোসেন।
বহু বছর আগে বসানো এই লাইনের ওপরেই রাস্তা নির্মাণের কাজ চলেছে, ভারী যান চলছে। একই পথে টানা হয়েছে বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য ইউটিলিটি লাইন। যা গ্যাসের সরবরাহ লাইনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
আবার অবৈধ সংযোগ নিতে পাইপলাইনে ছিদ্র করায় সেইসাথে মাটির ওপরে লাইনগুলো সুরক্ষিত না করায় সরবরাহ লাইনের অবস্থা জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
আধুনিক ব্যবস্থা নেই
গ্যাস সরবরাহ লাইনে বিভিন্ন কারণে তৈরি হওয়া এসব ছিদ্র খুঁজে বের করতে উন্নত দেশে বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয় আবার কোথাও গ্যাসের চাপ হঠাৎ কমে বা বেড়ে গেলে সেটাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা যায়। এতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া সহজ হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
এদিকে ঢাকা শহরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা গ্যাস পাইপলাইনের ও সংযোগের পরিপূর্ণ কোনো ম্যাপ বা জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমও সরকারের কাছে নেই। ফলে পাইপলাইনের অবস্থান জানা না থাকায় বিভিন্ন সংস্থা কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই তিতাসের পাইপলাইনে ছিদ্র তৈরি হচ্ছে। এটি গ্যাসের নেটওয়ার্ককে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে বলে জানান ইকবাল হোসেন।
গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি-২০১৪ অনুযায়ী, আবাসিক খাতে মিটার ছাড়া গ্রাহকদের ক্ষেত্রে দুই বছরে একবার এবং মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বাসায় বছরে একবার পরিদর্শনে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
তিতাস মূলত কাজ করে অভিযোগের ভিত্তিতে।
এমন অবস্থায় পাইপলাইনগুলো নিয়মিত তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন ইকবাল হোসেন। এজন্য নতুন পাইপলাইন প্রতিস্থাপন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহ সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি বলেও তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, ‘এই লাইনগুলো বসানোর পর আর কোনো রুটিন মাফিক তদারকি হয়নি। আবার যে হারে অবৈধ সংযোগ হয়েছে সেটার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। গ্যাস সংযোগের কোনো ডাটাবেস না থাকায় সরকার কোনো পরিকল্পনাও করতে পারছে না।’
এক্ষেত্রে দায়িত্ব ভাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি, যেখানে মূল সরবরাহ লাইনের তদারকি ও সংস্কার করবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে মূল সঞ্চালন লাইন থেকে বাসাবাড়িতে যে সংযোগ ঢুকবে সেটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে গ্রাহকদের। এই দায়িত্ব পালনের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ জরুরি বলে তিনি জানান।
সূত্র : বিবিসি