সময়ের পালাবর্তনে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলো রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আসা ১৪৪৪ হিজরির পবিত্র রমজানুল মুবারক। রমজানের পবিত্র আমেজ আর স্নিগ্ধ আবেশ এখনো প্রত্যেক রোজাদারের মন-মানসে বিরাজ করছে। এই পবিত্র স্নিগ্ধ আবেশময় মুহূর্তে একজন মু’মিনের উচিত নিজের চেতনাকে শাণিত করা। যাপিত জীবনের ছত্রে ছত্রে রমজানের পবিত্র রেশ ধরে রেখে নিজেকে সফলতার রৌদ্রময় প্রান্তরে অবিচল রাখা একজন সচেতন বুদ্ধিমান মু’মিনের অবশ্য কর্তব্য। তাই শাওয়ালে রমজানের রেশ ধরে রাখতে পাঁচটি মৌলিক কাজের ব্যাপারে যতœবান হওয়ার বিকল্প নেই।
১. রমজানের আমলগুলো নষ্ট না করা : রমজানজুড়ে একজন মু’মিন প্রচুর নেক আমল করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে, সে আমলগুলো নষ্ট না করা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেছেন- ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। আর তোমরা তোমাদের আমলগুলো নষ্ট করো না।’ (সূরা মুহাম্মদ-৩৩)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘আর তোমরা সে নারীর মতো হয়ো না, যে তার পাকানো সুতো শক্ত করে পাকানোর পর টুকরো টুকরো করে ফেলে।’ (সূরা নাহল-৯২)
আর আমল নষ্ট হওয়ার মৌলিক কারণগুলোর অন্যতম শিরক। ইরশাদ হয়েছে-
‘নিশ্চয়ই তোমাকে এবং তোমার আগের নবীদেরকে ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, তুমি যদি শিরক করো, তবে নির্ঘাত তোমার সব কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (সূরা জুমার-৬৫)
২. শয়তানের ধোঁকার ব্যাপারে সতর্ক থাকা : শয়তান মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। শয়তান মানুষকে সবসময় জাহান্নামের দিকে ডাকে। ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করো। সে তার দলকে কেবল এ জন্যই ডাকে যাতে তারা জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হয়।’ (সূরা ফাতির-৬)
শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় গমন করার ক্ষমতা রাখে। জাবির রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যাদের স্বামী উপস্থিত নেই, সেসব মহিলার কাছে তোমরা যেও না। কেননা, তোমাদের সবার মধ্যেই শয়তান (প্রবাহিত) রক্তের মতো বিচরণ করে। আমরা বললাম, আপনার মধ্যেও কি। তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমার মধ্যেও। কিন্তু আমাকে আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেছেন, তাই আমি নিরাপদ।’ (জামে তিরমিজি-১১৭২)
৩.সালাত না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করা : রমজানে সাধারণত সারাতের প্রতি আমাদের যথেষ্ট অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়। এই আগ্রহ উদ্দীপনা রমজানের পরেও বজায় রাখতে হবে। কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা সালাতের ব্যাপারে যতœবান হও। বিশেষ করে মধ্যবর্তী সালাত (আসর)। আর আল্লাহর ইবাদতে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে যাও।’ (সূরা বাকারাহ-২৩৮)
কিয়ামতের ময়দানে সর্বপ্রথম সালাতের হিসাব নেয়া হবে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম সালাতের হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে। যদি সালাত পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যায়, তবে তা পরিপূর্ণ লিখা হবে। যদি কিছু কম পাওয়া যায়, তাহলে আল্লাহ বলবেন, তার নফল সালাত কিছু আছে কি না? (যদি থাকে) এগুলোর দ্বারা ফরজ সালাতের ক্ষতিপূরণ করে দেয়া হবে। তারপর অন্যান্য আমলের ক্ষেত্রেও এরূপ করা হবে।’ (সুনানে নাসায়ি-৪৬৬)
৪. কুরআন তিলাওয়াত অব্যাহত রাখা : রমজানজুড়ে আমরা প্রচুর পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করে থাকি। রমজানের পরে এই পবিত্র অভ্যাস পরিত্যাগ না করে সাধ্যানুযায়ী তিলাওয়াত অব্যাহত রাখা উচিত। কুরআন পরিত্যাগ করা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং বেদনাদায়ক একটি কাজ। রাসূলুল্লাহ সা: কুরআন পরিত্যাগ করা নিয়ে যারপরনাই আক্ষেপ করতেন। পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘আর রাসূল বলেন, হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।’ (সূরা ফুরকান-৩০)
কুরআন চর্চা আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দের। আবু সাঈদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মহান রাব্বুল ইজ্জত বলেন, কুরআন (চর্চার ব্যস্ততা) ও আমার জিকির যাকে আমার কাছে কিছু আবেদন করা থেকে নিবৃত্ত রেখেছে আমি তাকে আমার কাছে যারা চায় তাদের চেয়ে অনেক উত্তম বকশিশ দেবো। সব কালামের ওপর আল্লাহ তায়ালার কালামের গৌরব এত বেশি যত বেশি আল্লাহ তায়ালার সম্মান তাঁর সব সৃষ্টির উপর।’ (জামে তিরমিজি-২৯২৬)
৫. শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখা : রমজান পরবর্তী শাওয়াল মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখা। এ রোজাগুলো প্রচুর সওয়াব ও ফজিলত বয়ে আনে।
আবু আইয়ুব আল আনসারী রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘রমজান মাসের সিয়াম পালন করে শাওয়াল মাসে ছয় দিন সিয়াম পালন করা সারা বছর সওম পালন করার মতো।’ (সহিহ মুসলিম-১১৬৪)
তাই আসুন উপরোক্ত আমলগুলো সম্পাদন করে যাপিত জীবনে রমজানের পবিত্র রেশ ধরে রাখি। ভোরের স্নিগ্ধ আলোর মতো জীবনকে আলোকিত করি।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর