রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:২৭ অপরাহ্ন

ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০২৩
  • ৬৩ বার

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়‘মোখায়’ পরিণত হয়েছে এবং এটি রবিবার যেকোনো সময় স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতর এমন তথ্য দেয়ার পর থেকে কক্সবাজারে এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা।

তবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা না থাকায় সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকে স্পিড বোট ও মাছ ধরার নৌকায় টেকনাফের দিকে সরে যেতে শুরু করেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।

সেইসাথে যারা সেন্টমার্টিনে টিন বা বাঁশের তৈরি ঘরে থাকেন, ঝড় আঘাত হানলে তারা সমুদ্র তীর থেকে দূরে বিভিন্ন রিসোর্টে সাময়িক আশ্রয় নেবেন বলে জানিয়েছেন।

সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, ‘আমাদের এখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রচার প্রচারণা হয় না, মাইকিং হয় না। স্থানীয়রা নিজ দায়িত্বে তাদের প্রস্তুতি নেয়, যাদের বোট (জলযান) আছে তারা টেকনাফে চলে যায়। আবার বয়স্ক ব্যক্তি বা যারা কাঁচা ঘরে থাকে তারা হয়ত রিসোর্টের বারান্দায় আশ্রয় নেয়।’

এদিকে কক্সবাজারের চারটি উপজেলা টেকনাফ, উখিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালীকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান।

স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টারের (এসওডি) নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সব কর্মকর্তাদের ছুটিতে না যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সাধারণত ৪ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দিলে মেগাফোন বা হ্যান্ড মাইকে প্রচারণা চালানো হয় সেইসাথে ফ্ল্যাগ ইন অর্থাৎ পতাকা টানিয়ে সতর্ক করা হয়। ফ্ল্যাগ ইনের নিয়ম হল সমুদ্রে ৪ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দিলে একটি পতাকা, ৬ নম্বর হলে দুটি পতাকা এবং ৭ বা এর বেশি সতর্কতার ক্ষেত্রে তিনটি পতাকা টানানো হয়।

তিনটি পতাকার অর্থ অতি দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলাজুড়ে থাকা ৫৭৬টি সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত করার কথা জানান সুফিয়ান।

সময় মতো সবাইকে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

তবে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় বসবাসকারীদের জন্য কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। তাদের ঘরবাড়িও বড় ধরনের ঝড় বৃষ্টি মোকাবেলার উপযোগী নয়।

এমন অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ইন চার্জের অফিস এবং শক্ত কাঠামোর হাসপাতাল, মসজিদ ও সরকারি দফতরগুলোতে সাময়িক আশ্রয় দেয়া হতে পারে বলে তিনি জানান।

আবু সুফিয়ান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণিঝড়গুলোর পূর্বাভাস নির্ভুল থাকায় মানুষ নিরাপদে সরে যেতে চায়। আমরাও সাইক্লোন সেন্টারগুলোতে নিরাপত্তা বাড়িয়েছি। সেখানে সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, শুকনো ও রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা রাখা হবে।’

এজন্য সরকারের বরাদ্দকৃত টাকা ও শুকনো খাবারের যেন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হয় সে বিষয়ে নজরদারি করার কথাও জানান তিনি।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় কক্সবাজারের প্রতিটি উপজেলায় রেড ক্রিসেন্টের আলাদা আলাদা দল গঠনের কথা জানিয়েছেন কক্সবাজার রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের যুব প্রধান আশরাফ হোসেন।

সতর্ক সঙ্কেত ৬ হলে, সেইসঙ্গে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা পাওয়া মাত্র এই দলগুলো কাজে নেমে পড়বে বলে তিনি জানান।

এরমধ্যে রয়েছে কন্ট্রোল টিম যারা সার্বিক তত্ত্বাবধানে কাজ করবে, মোবাইল মাইকিং টিম আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোয় প্রচার প্রচারণার কাজ করবে, দুর্যোগ চলাকালীন সময়ে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে মাঠে থাকবে ইউনিয়ন ডিজাস্টার রেসকিউ টিম, আশ্রয় কেন্দ্রে আহত কেউ থাকলে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবায় ফাস্ট এইড টিম কাজ করবে।

এরমধ্যে তারা কক্সবাজারের উপকূলীয় কয়েকটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো কুতুবদিয়া উপজেলার সমুদ্র সংলগ্ন সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, মহেশখালী, টেকনাফ, উখিয়া, কলাতলী, হিমছড়ি, পেকুয়ায় সমুদ্র সংলগ্ন এলাকা।

এসব এলাকার বাসিন্দাদের দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে তারা আগেভাগে কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন। তবে প্রতিবছরই উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে তারা দেখেছেন বেশিরভাগ মানুষ তাদের ভিটেবাড়ি ছেড়ে আসতে চায় না।

এমন অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়ার কথা জানিয়েছেন হোসেন।

তিনি বলেন, ‘আগে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের নিরাপদে যেতে বললেও তারা বুঝত না। কিন্তু ওদের লোকই যখন ওদের ভাষায় বুঝিয়ে বলে তাদের জিনিসপত্র নিরাপদ থাকবে, ভয়ের কিছু নাই, বরং এখানে থাকলেই ঝুঁকি, তখন তারা সরে আসতে চায়। আমরাও আশ্বাস দেই যে আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে তাদেরকে বিশুদ্ধ পানি আর খাবার দেয়া হবে। অনাহারে থাকতে হবে না।’

এদিকে সরকারের দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির পরিচালক আহমাদুল হক জানান, ইতোমধ্যে সেখানকার আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে।

তবে তিনি বেশি জোর দিচ্ছেন ভূমিধসপ্রবণ এলাকাগুলো থেকে লোকজনকে আগেভাগে সরিয়ে নেয়ার ওপর। কেননা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে পাহাড় ধ্বসের প্রবল ঝুঁকি রয়েছে।

সেইসাথে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের অন্তত দু’বেলার খাবার দিতে প্রয়োজনীয় টাকা এবং শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি জানান।

এছাড়া রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় প্রতিটি ক্যাম্পে ১০০ জন করে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা মূলত রোহিঙ্গাদের বাড়িগুলোকে সাময়িকভাবে মজবুত করার কাজ করবে।

সেইসাথে ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে ক্যাম্পের ভেতরে থাকা কনক্রিটের কাঠামোয় রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে এই স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করবেন বলে জানান হক।

তবে ঝুঁকিতে থাকা সেন্ট মার্টিনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন সুবিধা হল, সেন্ট মার্টিনে কোনো পর্যটক নেই। সেখানকার জনসংখ্যা খুব কম। যারা আছে তাদের বলা হয়েছে ওখানে কিছু ভালো অবকাঠামোয় তারা যেন আশ্রয় নেয়।’

ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় উপকূলবর্তী জেলাগুলোর প্রায় ১৫০ ফায়ার স্টেশন প্রস্তুত রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় ও পরবর্তী সময়ে যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো: এনামুর রহমান বুধবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কমিটির সভার শুরুতে সাংবাদিকদের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে জানান।

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ উপকূলীয় সব আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। সেখানে ১৪ টন শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে ২০০ টন চাল চলে যাবে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছি শেল্টার ম্যানেজমেন্টের জন্য। আমরা সবদিক থেকে প্রস্তুত রয়েছি।’

তিনি জানান, লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, আনসার, কোস্টগার্ড প্রস্তুত রয়েছে বলেও তিনি জানান।

ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাতে ক্ষয়ক্ষতি ও জানমালের ক্ষতি শূন্য পর্যায়ে থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়াসহ ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এরমধ্যে রয়েছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মেডিক্যাল টিম গঠন, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট, প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং সাপে কাপড় দেয়া রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অ্যান্টিভেনম মজুদ করা, অ্যাম্বুলেন্স এবং ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজনীয় জ্বালানিসহ প্রস্তুত রাখা।

সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com