চীনের উহান থেকে দুই মাস আগে যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, সেই নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হওয়ায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গতকাল শুক্রবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান ড. টেড্রস অ্যাডহানম গেব্রেইয়েসুস এই ঘোষণা দেন।
টেড্রস অ্যাডহানম বলেন, ‘‘আমরা এ বিপদকে খাটো করে দেখতে রাজি নই। এ কারণেই আমরা বলছি, এ ভাইরাসের বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। আমরা সতর্কতার মাত্রা ‘উচ্চ’ থেকে ‘সর্বোচ্চ’ ধাপে নিয়ে গেছি।”
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৫০টির বেশি দেশে এই করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। চীন থেকে শুরু হলেও নতুন নতুন দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে।
গতকাল শুক্রবারই ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার ছয়টি দেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ ভাইরাসে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। আর মারা গেছেন ২ হাজার ৮৭২ জনেরও বেশি।
ড. টেড্রস অ্যাডহানম বলেন , ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ভাইরাস চিহ্নিত করা যাচ্ছে এখনো। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ মেলেনি।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হেলথ ইমার্জেন্সি বিভাগের পরিচালক ডা. মাইক রায়ান বলেন, কোনো রোগের ঝুঁকি দেখলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যত ধরনের সতর্কতা জারি করতে পারে, এবারের মাত্রা তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সাংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় চীনে ৩২৯ জন নতুন রোগী পাওয়া গেছে, যা এক মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। চীনে আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৭৮ হাজার ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮শ মানুষের।
চীনের তিনটি বড় এয়ারলাইন্স আবার কাজে ফেরার ঘোষণা দিয়ে কিছু আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া সাংহাই ফ্যাশন শো এখন অনলাইনে চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু চীনের বাইরে পরিস্থিতি ক্রমশ নাজুক হয়ে উঠছে। অটোমোবাইল ব্যবসার অন্যতম বড় বার্ষিক আয়োজন জেনিভা কার শো স্থগিত করেছে সুইজারল্যান্ড।
লাতিন আমেরিকার দেশ মেক্সিকো, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া, ইউরোপের ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস ও লিথুয়ানিয়ায় প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর সবগুলো ঘটনার সঙ্গেই পাওয়া গেছে ইতালির যোগাযোগ।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালির অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। সেখানে ৬৫০ জনের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। চীনের বাইরে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে ২ হাজার ৩৩৭ জনের মধ্যে সংক্রমণ ঘটেছে, মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের।
তবে চীনের বাইরে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ইরানে। সেখানে আক্রান্ত হয়েছে ৩৮৮ জন, প্রাণ গেছে ৩৪ জনের। আক্রান্তদের মধ্যে ইরানের নারী ও পরিবার বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুমে এবতেকারও আছেন বলে দেশটির গণমাধ্যমগুলো নিশ্চিত করেছে।
বিবিসি শুক্রবার রাতে হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে ইরানে অন্তত ২১০ জনের মৃত্যুর খবর দিলেও দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তা অস্বীকার করেছেন। এর বাইরে জাপানে ১১ জন, হংকং ও ফ্রান্সে দুজন করে এবং ফিলিপিন্স ও তাইওয়ানে একজন করে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চীনের বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন মোট আক্রান্তের এক তৃতীয়াংশে দাঁড়িয়েছে।
বুলগেরিয়ায় এখনো কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। তবে দেশটি জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসীরা যাতে ভাইরাস নিয়ে ঢুকতে না পারে, সেজন্য তুরস্ক সীমান্তে এক হাজার সৈন্য পাঠাচ্ছে তারা। মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্ট বাতুলগা খালতমা চীন ঘুরে আসায় তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।
একজন চীনা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, সেরে ওঠা রোগীদের কারও কারও মধ্যে আবার নতুন করে উপসর্গ দেখা গেছে। তার মানে হলো, এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা যতটা কঠিন মনে হয়েছিল, আসলে তা আরও বেশি কঠিন হবে।
এদিকে, করোনাভাইরাস আতঙ্কে বিনিয়োগকারিরা কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। বরং তারা বিনিয়োগ করা টাকা তুলে নিতে চাইছেন। ফলে টানা পাঁচদিন ধরে টানা দরপতনের ধারায় রয়েছে শেয়ারবাজার। চীনের বাইরে গোটা বিশ্বে এ সংক্রমণ যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।