মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন রাজধানীবাসী। গত বছর মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এ কারণে আবার জনমনে ডেঙ্গু আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের কারণে আতঙ্ক আরও বিস্তৃত হয়েছে।
তাছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে দুই সিটির ১১টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে জানিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এতে পরিস্থিতি কতটা উন্নত হবে তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
ডিএনসিসি : গত বছর এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারের কারণে সে সময়ই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি টিম সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা তৈরি করে।
সম্প্রতি ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলে পৃথকভাবে অ্যাডভোকেসি সভার আয়োজন করা হয়। এতে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ডিএনসিসির কর্মকর্তারা মশা নিধনের বিভিন্ন উপায় তুলে ধরে জনসচেতনতা সৃষ্টি করেন। এ ছাড়া গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি ওয়ার্ডে বিশেষ মশক নিধন ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করেছেন তারা। ‘এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করি, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া মুক্ত থাকি’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে এডিস মশা নিধনে এ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
রাজধানীর মিরপুরে ১২ নং ওয়ার্ডে এই বিশেষ কার্যক্রম উদ্বোধনকালে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, আপনাদের সবার সহযোগিতাই পারে নগরবাসীকে এডিস মশা থেকে মুক্তি দিতে। জনসাধারণকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তিনি বলেন, আপনারা নিজ নিজ বাসাবাড়ি, ভবন এবং এলাকা নিজেরা পরিষ্কার করুন।
প্রয়োজনে আমাদের গাড়ি এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে, কিন্তু যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না, কোথাও পানি জমে থাকতে দিবেন না। ডাবের খোসা, টিনের কৌটা, পরিত্যক্ত বোতল, প্লাস্টিকের পট, হাঁড়ি, ভাঙা বা পরিত্যক্ত ফুলের টব যেখানে-সেখানে রাখবেন না।
এ দিকে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম শপথগ্রহণ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এখনো দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের কাছে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় আতিকুল ইসলাম বলেন, মশা অতি ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মশক নিধনে সব কাউন্সিলরকে সাথে নিয়ে এলাকায় এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নেবো আগামী ১৫ মে, তবে ২ মার্চ থেকেই মনিটরিং শুরু করব, দেখব মশকনিধন কর্মীরা সঠিকভাবে কাজ করছেন কি না। নির্বাচিত কাউন্সিলররাও সকাল-বিকেল তাদের কাজ তদারকি করবেন।
মেয়র বলেন, একটি সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়ার জন্য দলমত নির্বিশেষে কাজ করতে চাই।
ঢাকাবাসীকে যার যার বাসস্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, দলমত নির্বিশেষে আমরা ঢাকাকে একটি পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। গত বছর যারা যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখতেন তাদের জরিমানা করেছিলাম। আগামীতে কেউ এভাবে ময়লা-আবর্জনা ফেললে তাদেরও জরিমানা করা হবে।
ডিএসসিসি : ঝুঁকিপূর্ণ ছয়টি ওয়ার্ডে মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ক্র্যাশ প্রোগ্রামের উদ্যোগে নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডিতে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন মেয়র সাঈদ খোকন।
এ সময় মেয়র বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এর উৎস নির্মূল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তিনি নাগরিকদের সচেতন হওয়া এবং নিজ নিজ বসতবাড়ি, আঙিনা ও এর আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নাগরিকদের এডিস মশার প্রকোপ থেকে রক্ষাকল্পে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষিত এলাকাগুলো ঝুঁকিমুক্ত করতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে করপোরেশনের মশককর্মী ও পরিচ্ছন্ন পরিদর্শকরা ঘোষিত এলাকার প্রতিটি বাড়ি পরিদর্শন করে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে তা ধ্বংস করবেন এবং অধিবাসীদের লার্ভা ধ্বংস করার কৌশল শিখিয়ে দেবেন।
এরপরও কেউ সচেতন না হলে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক তিকর অবস্থা দৃষ্ট হলে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে সংশ্লিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ দিকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে ‘কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট’ তৈরি করার জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে ঢাকা দণি সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
সিঙ্গাপুরের আদলে ঢাকায় কিভাবে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে এতে। কৌশলপত্রটির আলোকে একটি প্রকল্প গ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এটি এখনো অনুমোদন হয়নি বলে জানা গেছে।
ডিএসসিসি মনে করছে, কৌশলপত্র অনুযায়ী সরকার যদি পদপে নেয়, তাহলে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত সবধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ডিএসসিসির এই কৌশল প্রচারের জন্য বিভিন্নভাবে প্রচারণার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পরিবেশগত বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমেও মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হবে। এ বিষয়ে প্রস্তাবনায় রয়েছে রাস্তা বা ড্রেনে পানি জমে থাকতে না দেয়া; অব্যবহৃত টায়ার, কৌটা, ক্যান, টব ও পাত্রসহ যেখানে এডিস মশার লার্ভা জমে সেসব নিয়মিত অপসারণ করা; বাসাবাড়িতে এডিস মশার প্রজননস্থল সৃষ্টি হতে না দেয়া এবং বাড়ির মালিকের নিজ উদ্যোগে এসব প্রজননস্থল ধ্বংসের ব্যবস্থা করা।
সরকারি অফিস, আদালত, শিাপ্রতিষ্ঠান, বাস টার্মিনালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়মিত পরিষ্কার করা। ড্রেন ও জলাশয়ে গাপ্পি মাছচাষ ও বিটিআই কর্তৃক ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে মশার লার্ভা ধ্বংস করা। সময়োপযোগী কার্যকর কীটনাশক নিয়মিত প্রয়োগ করা, সকাল ৮-১১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইড ও বিকেল ৫-৬টা পর্যন্ত অ্যাডাল্টিসাইড কার্যক্রম চালানো; ওয়ার্ডের প্রতিটি জায়গায় ন্যূনতম সপ্তাহে দুই দিন স্প্রে ও ফগিং করা। তবে আপৎকালীন সময়ে এর পরিমাণ বাড়াতে হবে। এজন্য দুই হাজার ৪০০ জনের একটি জনবল কাঠামো তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।