ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সালাত তার অন্যতম। ঈমানের পর সালাতের গুরুত্ব সর্বাগ্রে। সালাত জীবনে সফলতা বয়ে আনে। পবিত্র ও আলোকিত জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করে।
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার সালাতের হিসাব হবে। যদি সালাত ঠিক হয়, তবে তার সব আমল সঠিক বিবেচিত হবে। আর যদি সালাত বিনষ্ট হয় তবে তার সব আমলই বিনষ্ট বিবেচিত হবে (তাবরানি-১৯২৯)।
সালাত এমন এক ইবাদত, যা সারা বছর দৈনিক পাঁচবার আদায় করতে হয়। মৃত্যু ছাড়া আর কোনো অবস্থাতেই সালাত মাফ হয় না। এমনকি মৃত্যুশয্যায় স্বাভাবিক জ্ঞান থাকা অবস্থায় সালাত থেকে বিরত থাকার কোনো বিধান নেই।
পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মধ্যে ফজরের সালাতের গুরুত্ব আরো বেশি।
১. ফজরের সালাতে দাঁড়ানো, সারা রাত দাঁড়িয়ে সালাত পড়ার সমান। হজরত উসমান ইবনে আফফান রা: থেকে বর্ণিতÑ হজরত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার সালাত আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত জেগে সালাত পড়ল। আর যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতের সাথে পড়ল, সে যেন পুরো রাত জেগে সালাত পড়ল’ (মুসলিম-১০৯৬)।
২. ওই দিনের পুরোটা আল্লাহর জিম্মায় থাকার সৌভাগ্য হয়। ফজরের সালাত পড়লেই শুধু এ ঈর্ষণীয় সৌভাগ্য লাভ করা সম্ভব। সাহাবি জুনদব ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সুফিয়ান আল বাজালি রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের সালাত আদায় করল, সে আল্লাহর জিম্মায় চলে গেল। অতএব আল্লাহ যেন তার জিম্মার বিষয়ে তোমাদেরকে কোনোরূপ অভিযুক্ত না করেন’ (তিরমিজি-২১৮৪)।
৩. ফজরের সালাত কিয়ামতের দিন নূর হয়ে দেখা দেবে। হজরত বুরাইদা আল আসলামি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যারা আঁধারে (ফজর সালাতে) মসজিদের দিকে হেঁটে যায়, তাদের কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূর প্রাপ্তির সুসংবাদ দাও’ (আবু দাউদ-৪৯৪)।
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাতপ্রাপ্তির সুসংবাদ। আবু জুুহাইর উমারা ইবনে রুয়াইবা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে (ফজর ও আসরের সালাত) আদায় করবে, সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’ (মুসলিম-৬৩৪)।
৫. মুনাফেকি থেকে মুক্তি পাবে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুনাফেকদের ওপর ফজর ও এশার সালাত অপেক্ষা অধিক ভারী সালাত আর নেই। যদি তারা এর ফজিলত ও গুরুত্ব জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে বা পাছার ভরে অবশ্যই (মসজিদে) উপস্থিত হতো’ (বুখারি-৬৫৭)।
৬. সরাসরি আল্লাহর দরবারে নিজের নাম আলোচিত হবে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে পালাক্রমে দিনে ও রাতে ফেরেশতারা আসে। তারা আসর ও ফজরের সময় একত্র হয়। যারা রাতের কর্তব্যে ছিল তারা উপরে উঠে যায়। আল্লাহ তো সব জানেন, তবুও ফেরেশতাদের প্রশ্ন করেন, আমার বান্দাদেরকে কেমন রেখে এলে? ফেরেশতারা বলে, আমরা তাদেরকে সালাতরত রেখে এসেছি। যখন গিয়েছিলাম তখনো তারা সালাতরত ছিল’ (বুখারি-৫৪০)।
৭. দুনিয়া ও আখিরাতের সেরা বস্তু অর্জিত হয়। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ফজরের দুই রাকাত দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ (সহিহ মুসলিম-১২৪০)।
৮. পরিপূর্ণ এক হজ ও ওমরাহর সওয়াব পাবে, যদি সে সূর্য ওঠা পর্যন্ত আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকে। হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জামাতের সাথে ফজরের সালাত আদায়ান্তে বসে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থেকে সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত নফল সালাত (ইশরাক) আদায় করবে, সে পরিপূর্ণ এক হজ ও ওমরাহর সওয়াব পাবে। ‘পরিপূর্ণ’ এ শব্দটি তিনি (নবী করিম সা:) তিনবার বলেছেন’ (তিরমিজি-৫৮৬)।
৯. কিয়ামতের দিন সরাসরি আল্লাহকে দেখার সৌভাগ্য লাভ। আর এটি হচ্ছে সর্বোত্তম পুরস্কার। জারির ইবনে আবদুল্লাহ আল বাজলি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, এক রাতে আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে ছিলাম। হঠাৎ তিনি পূর্ণিমার রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শোনো! নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে তেমনি স্পষ্ট দেখতে পাবে, যেমন স্পষ্ট ওই চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তাকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই তোমরা যদি সূর্য ওঠার আগের সালাত ও সূর্য ডুবার আগের সালাত আদায়ে সমর্থ হও, তাহলে তাই করো।’ তার পর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, ‘সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসার তাসবিহ পাঠ করুন’ (বুখারি- ৫৭৩)।
ফজর মানে এক রাশ স্নিগ্ধতা। ফজর মানে হৃদয়জুড়ে ভালো লাগার অনির্বচনীয় অনুভূতি। ফজরের সালাত আদায় করা মানে দিনের শুরুতে আমাদের চিরশত্রু শয়তানের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা। ফলে সারাটা দিন জয়ের অনুভূতি নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে কাজ করা সহজ হয়ে যায়। কাজে মনোযোগিতা বাড়ে। এভাবে ফজরের সালাত জীবনজুড়ে সফলতার ফল্গুধারা বয়ে আনে। তাই আসুন গুরুত্বসহকারে স্নিগ্ধ ফজরে জেগে উঠি। নিয়মিত ফজরের সালাত ও পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে মনোযোগী হয়ে পবিত্র আলোকিত ও সুরভিত জীবন গড়ে তুলি।
লেখক :
মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম, টঙ্গী, গাজীপুর