নোভাক জোকোভিচের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের ম্যাচে দুই সেটে প্রবল লড়াই করেছিলেন কার্লোস আলকারাজ। কিন্তু তৃতীয় সেটে তৃতীয় গেমে চোট পাওয়া ম্যাচ থেকেই কার্যত ছিটকে দিলো তাকে। পুরো ম্যাচ খেলেই কোর্ট ছাড়লেন। কিন্তু প্রথম দুই সেটের আলকারাজকে খুঁজে পাওয়া গেল না বাকি দুই সেটে। অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন তিনি। ২৩ গ্র্যান্ড স্ল্যামের লক্ষ্যে ফরাসি ওপেনের ফাইনালে উঠে গেলেন জোকোভিচ। জিতলেন ৬-৩, ৫-৭, ৬-১, ৬-১ গেমে।
তবে প্রথম দু’টি সেট দেখে অন্তত এটা বোঝা গেছে, টেনিসের ‘বিগ থ্রি’র সমকক্ষ হয়ে এখনো সময় লাগবে আলকারাজের। তিনি প্রতিভাবান, হাতে শটের ছড়াছড়ি, ভাল কোর্ট কভারেজ, ড্রপ শটে বৈচিত্র- সব কিছুই রয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে এত ভুল করলে কখনওই চলে না। আলকারাজ ঠিক সেটাই করলেন। জোকোভিচকে অনায়াসে চাপে ফেলার রাস্তা তাঁর কাছে ছিল। কিন্তু গোটা ম্যাচে এত ‘আনফোর্সড এরর’ করলেন, যা তাকে অনেকটাই পিছিয়ে দিলো।
আলকারাজের খেলার মধ্যে এখনো বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যার দু’টি মূল কারণ, প্রচুর ‘আনফোর্সড এরর’ এবং ঘন ঘন ‘ড্রপ শট’ খেলার প্রবণতা। ড্রপ শট খেলা যে কঠিন এবং ঠিকঠাক জায়গায় বল রাখতে পারলে যে নিশ্চিত পয়েন্ট, এটা অনেকেই জানেন। কিন্তু ড্রপ শট মূলত ব্যবহার করা হয় পয়েন্ট পাওয়ার জন্য। আলকারাজ এত ঘন ঘন সেই শট খেলতে লাগলেন যে জোকোভিচের কাছে তার কৌশল বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। জোকোভিচ ঠিক উল্টো মানসিকতার খেলোয়াড়। তিনি ড্রপ শট মারেন প্রতিপক্ষের ছন্দ নষ্ট করার জন্যে। এ দিনও সেটাই হলো। আর তাতেই কিছুটা নড়ে গেলেন আলকারাজ। প্রথম সেটের শেষে ড্রপ শটের ক্ষেত্রে জোকোভিচের প্রাপ্ত পয়েন্ট আলকারাজের থেকে বেশি ছিল।
দ্বিতীয়ত, আলকারাজের ‘আনফোর্সড এরর’ সহজ জায়গা থেকেও খেলা কঠিন করে দিচ্ছে। এ দিন বেশ কিছু দৃশ্য দেখা গেল, যেখানে কঠিন শট তিনি অবলীলায় রিটার্ন করছেন। কিন্তু সহজ শট নেটে বা কোর্টের বাইরে মেরে দিচ্ছেন। প্রচুর পয়েন্টও খোয়ালেন। গোটা ম্যাচে ৫০টি ‘আনফোর্সড এরর’ করেছেন তিনি। জোকোভিচ সেখানে ৩৬টি। ‘উইনার’-এর দিক থেকেও ৩৯-৩৫ এগিয়ে জোকোভিচ। তবে ড্রপ শট এবং নেট পয়েন্টের ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে আলকারাজ। জোকোভিচ তেমনই এগিয়ে ‘লব শট’-এ। যখনই আলকারাজ নেটের কাছে এগিয়ে এসেছেন, তখনই জোকোভিচ বিপক্ষের মাথার উপর দিয়ে লব শট খেলে পয়েন্ট পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রথম সেট শেষ হতে লাগল ৫৯ মিনিট। দ্বিতীয় সেটে সময় লাগল ৭৭ মিনিট। অর্থাৎ দু’টি সেট শেষ হতে সময় লাগল প্রায় আড়াই ঘণ্টার কাছাকাছি। প্রতিটি পয়েন্টের জন্যে যে ভাবে আলকারাজ লড়াই করছিলেন, যেভাবে অনায়াসে কোর্ট জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন, তাতে ৩৬ বছরের জোকোভিচকে দেখে মনেই হচ্ছিল ম্যাচটা কঠিন হতে চলেছে। কে জানত তৃতীয় সেটে চোট পাবেন আলকারাজ!
ম্যাচের শুরুটা হয়েছিল দ্রুতগতিতে। প্রথম দুটি সার্ভ ধরে রেখে জোকোভিচ ২-১ গেমে এগিয়ে যান। এই গেমে জোকোভিচের একটি ক্রসকোর্ট ফোরহ্যান্ড উইনার দেখেই দর্শকরা বুঝতে পারেন, ম্যাচটা উত্তেজক হতে চলেছে। সেটা বোঝা গেল পরের গেমেই। আলকারাজকে ব্রেক করেন জোকোভিচ। কিন্তু ১৪ শটের যে র্যালি দেখা গেল, তা শেষ হওয়ার পর কেউই আর নিজের আসনে বসে থাকতে পারলেন না। দুই খেলোয়াড়ের র্যাকেট থেকেই বেরল ড্রপ শট। শেষ হাসি জোকোভিচের।
সপ্তম গেমে আবার নাটক। দুই খেলোয়াড়ই লম্বা র্যালি খেলতে থাকেন। নিজের সার্ভিস ধরে রাখতে জোকোভিচকে কী না করতে হল! তিন বার ব্রেক পয়েন্ট বাঁচালেন। পাঁচবার ‘ডিউস’ হলো। একটি গেমেই ১৪ মিনিট চলে গেল। শেষ পর্যন্ত ৫৯ মিনিটের লড়াইয়ের শেষে সেট গেল জোকোভিচের পকেটেই।
দ্বিতীয় সেটের শুরুতেও দু’জনে নিজেদের সার্ভ ধরে রাখলেন। তবে তৃতীয় গেমে আলকারাজের র্যাকেট থেকে সম্ভবত ম্যাচের সেরা শট দেখা গেল। ১৫-০ এগিয়েছিলেন তিনি। জোকোভিচ একটি ড্রপ শট মারেন। আলকারাজ ছুটে গিয়ে কোনও মতে রিটার্ন করেন। জোকোভিচ উঁচু করে ক্রসকোর্ট শট মেরেছিলেন। নেট থেকে বেসলাইনে ছুটে গিয়ে শট মারা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তবু আলকারাজ দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে বিপক্ষের দিকে না তাকিয়েই শট মারেন। জোকোভিচকে দাঁড় করিয়ে রেখে সেই পয়েন্টটি জিতে নেন আলকারাজ। তরুণ প্রতিপক্ষের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে হাসিমুখে জোকোভিচকেও হাততালি দিতে দেখা যায়।
দ্বিতীয় সেটে সাতটি গেমের পরেও কোনও ব্রেক আসেনি। আলকারাজ এগিয়ে ছিলেন ৪-৩ গেমে। পঞ্চম গেমে জোকোভিচকে ব্রেক করেন তিনি। তার ঠিক আগেই ডান হাতে চোটের শুশ্রূষা করাতে দেখা গেল জোকোভিচকে। মেডিক্যাল টাইম-আউট নিলেন। কিন্তু কোর্টে ফিরে ততটা সাবলীল দেখাল না তাকে। তবে ফিরতে সময় নেননি ২২ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক। পরের গেমেই আলকারাজকে ব্রেক করেন। দশম গেমে ০-৪০ পিছিয়ে গিয়েও নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন। পরের গেমেও জোকোভিচের সামনে ব্রেক করার সুযোগ চলে এসেছিল। কিন্তু সেটি নষ্ট করেন। তার পরেই আলকারাজ ব্রেক করে সেট পকেটে পুরে নেন।
প্রথম দু’টি সেটে যে রকম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল, তা দেখা গেল না তৃতীয় সেটে। গোটা কোর্ট দৌড়নোর কারণে এমনিতেই বাড়তি পরিশ্রম করতে হচ্ছিল আলকারাজকে। তৃতীয় গেমের সময় তাঁর ডান পায়ের পেশিতে টান ধরে। একটি শট রিটার্ন করতে গিয়ে ল্যান্ডিং ঠিক মতো হয়নি। শারীরিক ভাবে কিছুটা বিধ্বস্তও দেখাচ্ছিল। তার পুরোপুরি ফায়দা তুললেন জোকোভিচ। ব্রেক করলেন স্পেনের খেলোয়াড়কে। বস্তুত, গোটা সেট জুড়েই শারীরিক ভাবে বেশ অস্বস্তিতে দেখাল আলকারাজকে। জোকোভিচের ৬-১ জয়েই সেটা পরিষ্কার।
চতুর্থ সেটেও একই চিত্র। আলকারাজ ম্যাচটা ছেড়ে দেবেন কি না, সেটাই বোঝা যাচ্ছিল। কারণ, যে কোর্ট কভারেজের জন্য তিনি এক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন, সেই আলকারাজকেই দেখা যাচ্ছিল একের পর এক ছেড়ে দিতে। বলের ধারেকাছেই পৌঁছতে পারছিলেন না। জোকোভিচের কাছে খেলাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। পয়েন্টের জন্যে সে রকম কষ্টই করতে হচ্ছিল না তাকে। তবু ষষ্ঠ গেমে কোনোমতে একটি গেম ছিনিয়ে নেন তিনি। কিন্তু এই সেটটিও হারতে হয় ৬-১ গেমে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা