বেইজিংয়ে গ্রীষ্মের এক তপ্ত রাতে, লিওনেল মেসি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলার মাত্র ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে গোল করলেন। আর এটিই হাজার হাজার চীনা সমর্থককে মুগ্ধ করে তোলে।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) রাতে চীনের রাজধানীতে যেন নীল আর সাদা রঙের আর্জেন্টিনার জার্সির সাগর তৈরি হয়, যার প্রত্যেকটির পেছনের অংশে লেখা ছিল একটি নাম ‘মেসি’।
প্রতি গ্রীষ্মেই বেইজিং সাধারণত একটি আমন্ত্রণমূলক বন্ধুত্বপূর্ণ ফুটবল খেলার আয়োজন করে। এবার আয়োজকরা এমন একজন খেলোয়াড়ের নেতৃত্বে একটি দল বেছে নিয়েছেন, যিনি অন্য যে কারো চেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম।
দলে দলে সমর্থকরা বেরিয়ে আসলো, এই বিখ্যাত দলটির জন্য খুব বেশি একটা সমর্থন দেখানোর জন্য নয় বরং একজন মাত্র মানুষকে অভিবাদন জানানোর জন্য যার ছবি দীর্ঘদিন ধরে বিলবোর্ডে প্রদর্শন করে প্রায় সব ধরণের পণ্য বিক্রিরই ব্যবসা করা হচ্ছিল।
এটা ছিল এমন একটি দেশে স্টার পাওয়ার মার্কেটিং বা তারকার মাধ্যমে ব্যবসার একটি উপায় যে দেশে উচ্চমানের কোনো খেলোধুলা খুব একটা হয় না।
স্ট্যান্ডের চারপাশে উল্লাস প্রতিধ্বনিত হয়- মেসিইইই মেসিইইই- আর মাঝে মাঝে আহহ-জেন-টিং! (চীনা ভাষায় আর্জেন্টিনা)।
খেলার টিকিট অত্যধিক হারে বিক্রি হয়েছিল। এগুলোর বেশিরভাগেরই দাম চার শ’ ডলার থেকে শুরু করে করে ৬৮০ ডলার পর্যন্ত ছিল। এর ফলে চীনা সোশ্যাল মিডিয়াতে এক ধরণের কৌতুক শুরু হয় যেখানে বলা হয়, নবনির্মিত ওয়ার্কার্স স্টেডিয়ামে এতো বেশি দাম আশাই করা যায় না।
কিন্তু তারপরও ৬৮ হাজার টিকিট পলকে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। দর্শকরা এসেছিলেন পুরো চীন থেকে।
লিওনেল মেসি না থাকলে, এটা হয়তো সম্ভবই হতো না।
আর্জেন্টাইন তারকা চীনে পৌঁছানোর পর থেকেই বেইজিংয়ে মেসি ম্যানিয়া চলছে। ভক্তদের অনেকে দলটি যে হোটেলে উঠেছে তার বাইরে শিবিরি স্থাপন করে অবস্থান করেছে। এমনকি যা খেলার আগে অনুশীলনের জন্য বের হওয়া তাদের পক্ষে কঠিন করে তুলেছে।
কিছু সমর্থক দামি ফাইভ-স্টার হোটেলের কক্ষ ভাড়া করেছেন শুধু এই আশায় যে, যদি খেলোয়াড়দের এক ঝলক দেখা যায় যারা তাদের দেশকে বিশ্বকাপের গৌরব অর্জন করে এনে দিয়েছিলেন।
তাকে দেখার একটি বিকল্প সুযোগ সম্প্রতি ভক্তদের জন্য এসেছিল। আর তা হচ্ছে, তাওবাও নামে একটি অনলাইন বিক্রয় প্ল্যাটফর্ম একটি ফ্যান প্রমোশন লাইভ স্ট্রিমের আয়োজন করেছিল। এই অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেয়ার সুযোগ খুব সস্তা ছিল না। বরং তাওবাও এর মাধ্যমে পকেট ভরেছে এবং স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৫ লাখ দশর্ক এই লাইভ অনুষ্ঠান দেখেছিল।
প্রকৃতপক্ষে, মেসির উপস্থিতি ঘিরে বেইজিংয়ে উন্মাদনা এতটাই চরম ছিল যে, পুলিশকে ভক্তদের সতর্ক করেছিল যে তারা যাতে মেসির সাথে ডিনার বা এমন কোনো ভিআইপি সুযোগের প্রস্তাব পেয়ে প্রতারিত না হন।
চীনে মেসির বিশাল পরিচিত আছে। তার নাম এমন মানুষেরাও জানে যারা হয়তো ফুটবল সম্পর্কে আর কিছুই জানে না।
বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের চীনের জাতীয় দলের বিপক্ষে মাঠে না নামিয়ে বরং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নামানোটা একটা আকর্ষনীয় সিদ্ধান্ত ছিল।
তত্ত্বগতভাবে, প্রোমোটাররা আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলতে যেকোনো দলকে আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন।
অনেকে মনে করেন যে, আয়োজকরা চীনা দর্শকদের নিজের দেশের বিরুদ্ধে মেসিকে গোল করতে দেখে আবার মেসির জন্য উল্লাস করার মধ্যে যে একটা ঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে সেটি চাননি।
শেষ পর্যন্ত তারা এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দল অস্ট্রেলিয়াকে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছে। আর অস্ট্রেলিয়ানদের জন্য, তাদের আসলে হারানোর কিছুই ছিল না।
গত বছর কাতারে বিশ্বকাপে শেষ ১৬-তে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ২-১ গোলে পরাজিত হওয়ার পর কেউ কল্পনাই করেনি যে তারা এবার জিতবে।
তারা তুলনামূলক নতুন একটি দল নিয়ে বেইজিং গেছে, সেখানে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের সাথে তাদেরকে মাঠে নামিয়েছে, আগামী বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে।
এরপরও, অল্পসংখ্যক অস্ট্রেলিয়ান সমর্থক যারা মাঠে উপস্থিতি ছিলেন, তাদের উল্লাসিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত উপাদন ছিল।
মেসির প্রথম গোলের পর তারা আর্জেন্টিনার আক্রমণের প্রতিহত করে এবং তারা আক্রমণাত্মকভাবে খেলতে শুরু করে। গোল করার বেশ কয়েকটি সুযোগ হাতছাড়া করলেও চীনা জনতা উল্লাস করে এবং প্রশংসায় হাততালি দেয়।
কিন্তু, এ ধরণের একটি প্রীতি ম্যাচেও, আর্জেন্টিনা নিজেদেরকে আলাদা করে ধরে রেখেছিল এবং তাদের দ্বিতীয় গোলটি তাদের জয় নিশ্চিত করে।
খেলা শেষ হওয়ার পর, শিশু আর বয়স্কদের একটি জনস্রোত স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসে এবং এতে করে বেইজিংয়ের সানলিতুন জেলার রাস্তাগুলো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এসব ভক্তদের মধ্যে অনেকের মুখে রঙ করা ছিল।
মেজাজ ছিল উল্লাসিত। এত টাকা খরচ করে মানুষ আফসোস করেছে বলে মনে হয়নি।
‘এটা সত্যিই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল,’ একজন তরুণী বিবিসিকে বলেছেন। ‘টিকিটের দাম অনুযায়ী আয়োজনটা উপভোগ্য ছিল। অবসরে যাওয়ার আগে এটিই হবে মেসির শেষ চীন সফর। তাই এটি সত্যিই মূল্যবান ছিল।’
‘এটি একটি দুর্দান্ত খেলা ছিল,’ একজন ব্যক্তি বলেন। ‘মেসির প্রথম গোলটি আমি সত্যিই পছন্দ করি।’
আর তার প্রিয় খেলোয়াড়কে, আমি জিজ্ঞেস করলাম?
তিনি পেছনে ঘুরে তার আর্জেন্টিনার ফুটবল জার্সির পিছনে ‘মেসি’ লেখাটা দেখিয়ে দিলেন।
চাইনিজ ভক্তরা এমন একটি জাতীয় দল পেতে খুব পছন্দ করবে যারা একদিন অন্য শীর্ষ-স্তরের দলগুলোর সাথে মিশে যেতে পারবে।
ততদিন পর্যন্ত এই ভক্তদের অনেকেই বড় নাম আর বড় ক্লাবকে অনুসরণ করবে।
তবে এই সপ্তাহে চীনে এমন একজন খেলোয়াড় ছিলেন যিনি ইতিমধ্যে নিজের দেশে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন।
লিওনেল মেসির খ্যাতির কারণে বিশ্বের অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে আর্জেন্টিনা বিশাল জনতার সামনে দৌড়ে খেলেছে যা তাদের জন্য ঘরের মাঠে খেলার মতোই অনুভূতি দিয়েছে।
সূত্র : বিবিসি