আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে সিলেট বিভাগের তিন জেলায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সীমান্তের ওপার থেকে ধেয়ে আসা ঢলের পানির কারণেই মূলত সিলেট বিভাগের তীরবর্তী অঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সিলেটের সাথে নেত্রকোনা জেলার নদীতীরবর্তী অঞ্চলেও বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জে টানা বর্ষণে পানি বাড়ছে। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের শহরতলি প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জে বানের পানিতে ডুবে তিন ভাইবোনের মৃত্যু হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগ আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর সংলগ্ন ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে।
বাংলাদেশে এ সময়টা বর্ষাকাল এবং ভরা বর্ষা চলছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। ফলে সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার কিয়দংশে এবং উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে মৌসুমি বায়ুর ফলে প্রচুর মেঘ জমা হচ্ছে। গতকাল রোববার সিলেট বিভাগে জেলাগুলোতে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন জায়গায় বিল-ঝিল ভরে গিয়ে চলাচলের রাস্তাও ডুবিয়ে দিয়েছে ভারী বৃষ্টি। ইতোমধ্যে সিলেটের উজান থেকে প্রচুর পানি নেমে আসছে নদীগুলো বেয়ে। এ ছাড়াও ছোট-বড় ঢলের পানিতে ভরে যাচ্ছে নদী ও হাওরগুলো। ফলে খুব শিগগিরই সিলেট বিভাগের তিন জেলা এবং নেত্রকোনা জেলার হাওরগুলো ভরে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, সিলেটের সুরমা, পুরাতন সুরমা, যদুকাটা, সারিগোয়াইন, খোয়াই এবং নেত্রকোনা জেলার সুমেশ্বরী, ভোগাই-কংশ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিলেট সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার কিছু নিম্ননাঞ্চলে ও নদীতীরবর্তী অঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী বন্যা শুরু হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশের উজানে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা দুধকুমার নদীর পানি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রচুর ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে গত ২৪ ঘণ্টায়। এই পানি নদী, বিল ও হাওরে নেমে আসতে শুরু করেছে। গতকাল রোববার সারা দিন সুনামগঞ্জ জেলার ওপরও বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৩৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। শেরপুর-সিলেটে ১৭৫ মিলিমিটার, লুরেরগাঁওয়ে ১১১ মিলিমিটার, নকুয়াগাঁওয়ে ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়ে গেছে। এই এলাকার তীরবর্তী নদীতে বন্যা হতে এই ভারী বর্ষণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের যে ১০৯টি স্টেশনে পানি পর্যবেক্ষণ করে এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৯টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার মেঘালয় সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোয় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল সারা দিন রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোর ওপর মাঝারি ধরনের বর্ষণ হয়ে গেছে। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাড়াশে ৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া অফিস বলেছে। সেই সাথে খুলনা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বরগুনা জেলায় মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়।
আজ সোমবার রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। এ ছাড়া ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় একই ধরনের মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
সুনামগঞ্জে বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে বন্যার আশঙ্কা : বিপর্যস্ত জনজীবন
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জে টানা বর্ষণে বাড়ছে পানি, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
ঈদুল আজহার আগের দিন থেকে টানা পাঁচ দিনের বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানিতে সুনামগঞ্জের সুরমা, জাদুকাটা, বৌলাই নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মুসলধারের বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা পানিতে সব ক’টি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভপুর, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জসহ সব ক’টি উপজেলায় নিম্ননাঞ্চলে প্লাবিত হয়ে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির ভয় সৃষ্টি হচ্ছে জনমনে।
সুনামগঞ্জে গত বছর এ সময় ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের সব ক’টি উপজেলা ও হাওরের বিচ্ছিন্ন পল্লী প্লাবিত হয়েছিল। কয়েক দিন বিদ্যুৎহীন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে ছিল। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত মাথায় নিয়ে হাজারো মানুষ ছোটেন আশ্রয়ের খুঁজে। উঁচু ভবন, আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘর, সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেন মানুষ। চার দিন সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জে সরকারি হিসাবে কমবেশি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। বানের পানিতে ১৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। প্রায় ৫০ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখন তাড়া করছে সুনামগঞ্জবাসীকে।
সুনামগঞ্জের সুরমাসহ সব নদনদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সুনামগঞ্জ শহরসহ জেলার নিম্ননাঞ্চলে প্লাবিত হয়েছে।
রোববার গতকাল দুপুর পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ছয় সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলা শহরসহ একাধিক উপজেলার নিম্ননাঞ্চলে প্লাবিত হওয়ার ফলে বন্যাপরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। লোকালয়, রাস্তাঘাটে পানি প্রবেশ করায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অনেকেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৩৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। উজানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় সুরমা, কুশিয়ারা, জাদুকাটা, রক্তি, বৌলাই ও চেলাসহ জেলার প্রধান প্রধান নদনদীর পানি বেড়ে নদী তীরবর্তী নিম্ননাঞ্চলে বন্যাপরিস্থিত দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন সুনামগঞ্জ পৌরশহরের বড়পাড়া, পশ্চিম হাজীপাড়া, কাজির পয়েন্ট, সুলতানপুর, নবীনগর এলাকার বাসিন্দারা। এ ছাড়া পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন জেলার ছাতক, দোয়ার বাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা মধ্যনগরসহ একাধিক উপজেলার মানুষ। জেলার তাহিরপুর সুনামগঞ্জ সড়কের শক্তিয়ারখলা ও আনোয়ারপুর এলাকার সাবমার্জেবল অংশ পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে ঈদে বাড়ি থেকে কর্মস্থল ফেরত মানুষসহ এলাকাবাসী।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মাকসুদ চৌধুরী বলেন, জেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে নগদ ২৫ লাখ টাকা, ৬০০ মেট্রিক টন চাল, ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার মজুদ রাখা হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত পাঁচ দিনের অব্যাহত বৃষ্টিতে সুরমা, কুশিয়ারা, জাদুকাটা, বৌলাই নদীসহ ছোট-বড় সব নদীর পানি তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। এ ছাড়াও হাওর এলাকায় পানি বাড়ছে।
সুনামগঞ্জে সুরমা নদীতে রোববার বিকেলে পানি বিপৎসীমার ছয় সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
নৌডুবিতে ৩ ভাই-বোনের মৃত্যু : সুনামগঞ্জে নৌডুবিতে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের বাড়ি সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে। গোবিন্দপুর গ্রামের সোহেল মিয়ার তিন সন্তান আপন তিন ভাই বোন, তন্নি (১২) তান্নী (৮) রবিউলের (৩) নৌকাডুবিতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া বিরাজ করছে।
স্থানীয় ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, নিহত শিশুরা তাদের নিজ গ্রাম গোবিন্দপুরের বাড়ির পাশেই একটি ছোট্ট নৌকায় করে পানিতে ঘুরতে যেতে চাচ্ছিল। নৌকায় ওঠার পর ভাঙা নৌকার ছিদ্র দিয়ে পানি উঠতে উঠতে হঠাৎ করে নৌকাটি ডুবে যায়। স্থানীয় প্রতিবেশীরা এই ঘটনা দেখে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে এবং তারা ফায়ার সার্ভিসে খবর দিয়ে আশপাশের লোকজন তাদেরকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর লাশ উদ্ধার করে। সুনামগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তারেক হাসান ভূঁইয়া বলেন, উপজেলার নির্বাহী অফিসার উদ্ধার করা লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন।