নোভাক জোকোভিচ যখন উইম্বলডনের ফাইনাল খেলতে বের হচ্ছিলেন তখন তার যাত্রাপথে পানির ছিটা দেন তার স্ত্রী জেলিনা জোকোভিচ। সার্বিয়ার লোকগল্প অনুযায়ী, কেউ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার যাত্রাপথে পানির ছিটে দেয়া ভালো লক্ষণ। তাতে কার্যসিদ্ধি হয়। কিন্তু আদতে সেটা হলো না। প্রথম সেট হেরে গেলেও খেলায় ফিরলেন কার্লোস আলকারাজ। পাঁচ সেটের লড়াইয়ে জোকোভিচকে হারিয়ে নিজের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেন স্পেনের খেলোয়াড়। মাস দেড়েক আগেই ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালে জোকোভিচের কাছে হেরেছিলেন তিনি। সেই হারের বদলা নিলেন আলকারাজ। উইম্বলডনে জোকোভিচের বিজয়যাত্রা থামালেন তিনি। টানা চারবার জেতার পরে পঞ্চমবারে হারতে হলো জোকোভিচকে। ছোঁয়া হলো না রজার ফেদেরারের আট উইম্বলডনের নজির।
রোববার মহাকাব্যিক ফাইনালের আশায় বসেছিল টেনিস বিশ্ব। এক দিকে ২৩ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক জোকোভিচ। উইম্বলডনে টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত। শেষ হেরেছিলেন ২০১৭ সালের কোয়ার্টার ফাইনালে টমাস বার্ডিচের কাছে। টানা পাঁচবার উইম্বলডন জিতে রজার ফেদেরারকে ছুঁয়ে ফেলার সুযোগ ছিল সার্বিয়ার খেলোয়াড়ের সামনে। ঘাসের কোর্টে ঈর্ষণীয় রেকর্ডের মালিক জোকোভিচের (১০৯ জিত, ১৮ হার) সামনে ছিলেন বিশ্বের এক নম্বর তারকা আলকারাজ। চলতি বছর ভালো খেললেও গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারেননি। মাস দেড়েক আগে ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালে জোকোভিচের বিরুদ্ধে চোট ভুগিয়েছিল স্পেনের খেলোয়াড়কে। এই ম্যাচে সেটা হলো না। উল্টে যত ম্যাচ গড়াল তত ক্লান্ত হয়ে পড়লেন জোকোভিচ। দু’জনেই অনেক ভুল করেছেন। বেশি ভুল করে ম্যাচ হেরেছেন জোকোভিচ।
টান টান লড়াইয়ে পাঁচ সেটে খেলা গড়ালেও যে মানের টেনিস তাদের কাছে আশা করা হয়েছিল, তা দেখা গেল না। ঘাসের কোর্টে শরীরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছিল দুই খেলোয়াড়েরই। বেশি সমস্যায় পড়েন জোকোভিচ। গোটা ম্যাচে অন্তত চারবার পিছলে পড়লেন তিনি। তাতে বড় চোট লাগতে পারত তার। পড়লেন আলকারাজও। হাওয়ার জন্যও সমস্যা হচ্ছিল। এই প্রতিবন্ধকতা বেশি ভোগাল জোকোভিচকে। শেষ পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা ৪২ মিনিটের লড়াইয়ে ১-৬, ৭-৬ (৮-৬), ৬-১, ৩-৬, ৬-৪ গেমে ৩৬ বছরের জোকোভিচকে হারালেন ২০ বছরের আলকারাজ।
বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় হলেও গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে স্নায়ুর চাপ ধরে রাখা কঠিন ছিল আলকারাজের পক্ষে। অন্তত প্রথম সেটে সেটাই দেখা গেল। নইলে কেন খেলার শুরুটা নিজে না করে জোকোভিচকে করতে দিলেন তিনি! প্রথম গেমেই জোকোভিচের সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পেয়েছিলেন আলকারাজ। কিন্তু পারলেন না। দ্বিতীয় গেমে আবার নিজের সার্ভিস ধরে রাখতে সমস্যায় পড়লেন স্পেনের খেলোয়াড়। তার সার্ভিস ভেঙে ২-০ এগিয়ে গেলেন জোকার। আলকারাজের পরের সার্ভিসও ভেঙে দিলেন জোকোভিচ। দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কতটা চাপের মধ্যে রয়েছেন আলকারাজ। তার মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করল গোটা সেন্টার কোর্ড। আলকারাজ প্রতিটি পয়েন্টে হাততালি দিলেন ব্র্যাড পিট, ড্যানিয়েল ক্রেগের মতো হলিউড তারকা। তার পরও প্রথম সেটে মাত্র একটি গেম জিতলেন আলকারাজ। ৬-১ প্রথম সেট জিতে নিলেন জোকার। সময় নিলেন মাত্র ৩৪ মিনিট।
প্রথম সেটের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, আলকারাজকে হয়তো দাঁড়াতে দেবেন না ২৩ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক। কিন্তু দ্বিতীয় সেটে ফিরলেন আলকারাজ। দ্বিতীয় গেমেই জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে দিলেন তিনি। কিন্তু জোকোভিচও ছাড়ার পাত্র নন। চতুর্থ গেমে আলকারাজের সার্ভিস ভেঙে খেলায় ফিরলেন তিনি। পরের কয়েকটি গেমে দু’জনেই নিজেদের সার্ভিস ধরে রাখেন। ফলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানেও একটা সময় ৫-৪ এগিয়ে ছিলেন জোকোভিচ। ঠিক সেই মুহূর্তে সময়ের মধ্যে সার্ভিস না করার জন্য জোকোভিচকে সতর্ক করেন চেয়ার আম্পায়ার। সেই কারণে হয়তো কিছুটা হলেও মনঃসংযোগে ব্যাঘাত হয় জোকারের। কারণ, পরের তিনটি পয়েন্টে সহজ শট মারতে গিয়ে ভুল করে বসেন নোভাক। তার সুবিধা পান আলকারাজ। ৮-৬ টাইব্রেকার জিতে দ্বিতীয় সেট জিতে যান স্পেনের খেলোয়াড়।
তৃতীয় সেটের শুরু থেকে আরও আত্মবিশ্বাসী খেলা শুরু করলেন আলকারাজ। তিনি যত ছন্দ পাচ্ছিলেন, তত ছন্দ হারাচ্ছিলেন জোকোভিচ। সেন্টার কোর্টে হাওয়া কিছুটা সমস্যায় ফেলছিল তাকে। কয়েকটি শটে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি সার্বিয়ার তারকা। অন্য দিকে প্রথম দুই সেটে ড্রপ শট সমস্যায় ফেলছিল আলকারাজকে। এই ড্রপ শটই তার শক্তি। কিন্তু হাওয়ার কারণে কিছুতেই ঠিক ঠাক জায়গায় মারতে পারছিলেন না। বার বার নেটে গিয়ে লাগছিল। তৃতীয় সেট থেকে ড্রপ শট ঠিক মতো মারতে শুরু করলেন আলকারাজ। আর ড্রপ শট কাজে এলে তিনি যে অন্য রকমের খেলোয়াড় হয়ে যান সেটাই দেখা গেল।
তৃতীয় সেটের প্রথম গেমেই জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে দেন আলকারাজ। তার পর নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন। চতুর্থ গেমে জোকারের কাছে সুযোগ ছিল আলকারাজের সার্ভিস ভাঙার। কিন্তু পারেননি তিনি। প্রতিটি গেমে লম্বা র্যালি খেলা শুরু করেন তারা। যেন একে অপরের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। সহজে কেউ ছাড়ছিলেন না। অহেতুক ভুল করছিলেন জোকোভিচ। প্রথম দুই সেটে জোকোভিচ সার্ভিস করছিলেন আলকারাজের ব্যাকহ্যান্ড লক্ষ্য করে। তার ফলে সমস্যায় পড়ছিলেন আলকারাজ। কিন্তু তৃতীয় সেট থেকে অনেক বেশি আলকারাজের ফোরহ্যান্ডে সার্ভিস শুরু করেন জোকোভিচ। ফলে রিটার্ন করতে সুবিধা হচ্ছিল আলকারাজের। জোকোভিচের ভুলের সুযোগ নিচ্ছিলেন স্পেনের খেলোয়াড়। প্রথম সেটে জোকোভিচ যে ভাবে দাপট দেখিয়ে জিতেছিলেন, তৃতীয় সেটে সেটাই করলেন আলকারাজ।
ম্যাচের সব থেকে কঠিন লড়াই হলো তৃতীয় সেটের পঞ্চম গেমে। ২৬ মিনিট ধরে চলল একটি গেম। ৩২টি পয়েন্টের খেলা হল। প্রথম সার্ভিসে বার বার সমস্যা হচ্ছিল জোকোভিচের। তার ফলে পয়েন্ট তুলতে পারছিলেন না তিনি। একবার জোকোভিচ এগোচ্ছিলেন তো পরের পয়েন্টেই আলকারাজ এগিয়ে যাচ্ছিলেন। গোটা গেমে ১৩ বার ডিউস (৪০-৪০) হয়। সেই গেমেই আরো এক বার সময় নষ্টের জন্য জোকোভিচকে সতর্ক করেন আম্পায়ার। সেই সময় আম্পায়ারের সঙ্গে তার কিছুটা তর্ক হয়। টানা র্যালি হওয়ায় কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল জোকোভিচকে। কিন্তু কেউ হাল ছাড়ছিলেন না। সাতবার ব্রেক পয়েন্ট পান আলকারাজ। শেষ পর্যন্ত জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যান আলকারাজ। তার পরে আর সেই সেটে রোখা যায়নি আলকারাজকে। জোকোভিচের পরের সার্ভিস ভেঙে ৬-১ সেট জিতে এগিয়ে যান তিনি।
তৃতীয় সেটের পরে সাত মিনিটের একটি বিরতি নেন জোকোভিচ। ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালেও দ্বিতীয় সেটের পরে বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। ততক্ষণে আলকারাজের বিরুদ্ধে খেলা ১-১ ছিল। পরের দু’টি সেট জিতে ম্যাচ জিতে যান জোকার। এবারেও তার সমর্থকেরা আশা করেছিলেন, তেমনই কিছু চমৎকার দেখাবেন জোকোভিচ। ফিরে এসে শুরুটা সে রকমই করলেন। চতুর্থ সেটের পঞ্চম গেমে আলকারাজের সার্ভিস ভাঙলেন তিনি। সেই সেটে আর জোকোভিচের সামনে দাঁড়াতে পারেননি আলকারাজ। নবম গেমে আবার তাঁর সার্ভিস ভেঙে ৬-৩ সেট জিতে যান তিনি। খেলা গড়ায় পঞ্চম সেটে।
নির্ণায়ক সেটে দ্বিতীয় গেমেই আলকারাজের সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পেয়েছিলেন জোকোভিচ। ঠিক মতো ভলি মারতে পারলেই এগিয়ে যেতেন তিনি। কিন্তু সোজা নেটে সেই ভলি মারলেন জোকার। সুযোগ পেয়ে নিজের সার্ভিস ধরে রাখলেন আলকারাজ। কিন্তু জোকোভিচ নিজের সার্ভিস ধরে রাখতে পারলেন না। রাগের মাথায় কোর্টে আছড়ে ভেঙে ফেললেন র্যাকেট। বোঝা যাচ্ছিল, খেলা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন জোকোভিচ। মানসিক ভাবেও কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছিল তার। নইলে যে ভাবে একের পর এক বাজে শট মেরে পয়েন্ট হারাচ্ছিলেন তা জোকোভিচের কাছে শেষ কবে দেখা গিয়েছে মনে করা মুশকিল। একবার পিছিয়ে পড়ার পরে আর ফিরতে পারেননি জোকোভিচ। শেষ পর্যন্ত হেরেই কোর্ট ছাড়তে হয় তাকে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা