শ্বাসরুদ্ধকর ৪৮ ঘন্টার মাথায় রোববার দুপুরে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন ও প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যান। গুরুতর অসুস্থ্য থাকায় তাকে কারাগার থেকে বের করে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এ ঘটনায় রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় গঠিত তদন্ত কমিটি মন্ত্রিপরিষদে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে ডিসি সুলতানা পারভীনসহ চারজনকে অভিযুক্ত করে ঘটনাটি বিধি বহির্ভূত উল্লেখ করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারশি করা হয়েছে।
এদিকে রোববারই ডিসি প্রত্যাহারের ঘোষণা ও বিভাগীয় মামলা দায়েরের ঘোষণা দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, পরিবারের কেউ আরিফের জামিনের জন্য আবেদন করেনি। কুড়িগ্রাম বারের এ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের আবেদনের পর কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সুজাউদ্দৌলা তাকে জামিন দেন। জামিনের পর অসুস্থ্য রিগ্যানকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার ওপর শুক্রবার মধ্যরাতে উলঙ্গ করে মারধোর করার অভিযোগ আছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে সাংবাদিক আরিফ জানিয়েছেন, রোববার সকালের দিকে জেল কর্তৃপক্ষ তার কাছে একটি ওকালতনামা পাঠায়। তাকে বলা হয় পরিবার পাঠিয়েছে। এই কথা বলে স্বাক্ষর নেয়া হয়। তবে পরিবারের কেউ ওকালতনামায় স্বাক্ষর নেয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো কাগজ পাঠাননি।
এসময় কুড়িগ্রাম বারের এ্যডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন জানান, কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি আহসান হাবীব নিলু তার সাথে যোগাযোগ করে দুজনে মিলে ২৫ হাজার টাকা জামানতে জামিন করা হয়েছে।
জামিনের পর রিগ্যানের বক্তব্য
জামিনে মুক্ত হওয়ার সাংবাদিক রিগ্যান ভয়াবহ সেই ঘটনার বিষয়ে বলেন, দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেই আরডিসি আমার মাথায় কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন। মারতে মারতে আমাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চোখ-হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। এরপর আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে এনকাউন্টার দিতে চায়। আমাকে বারবার বলে, তুই কলেমা পড়ে ফেল, তোকে এনকাউন্টার দেয়া হবে। এ সময় আমি অনেক অনুনয় বিনয় করি, প্রাণভিক্ষা চাই। বলি, আমার বাবা-মা নেই, আমার দুটি সন্তান আছে। আমাকে যেন না মেরে ফেলা হয়। মেরে ফেললে আমার বাচ্চা দুটি এতিম হয়ে যাবে। পরে তারা আমাকে গাড়িতে করে একটি ভবনে নিয়ে যায়। আমি চোখের কাপড় একটু খুলে বুঝতে পারি এটা ডিসির কার্যালয়।
আবার আরডিসির নেতৃত্বে আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে বিবস্ত্র করে। এরপর বেধড়ক মারধর করে বলে তোর ভিডিও করে রাখছি। এ সময় আমাকে গালাগাল করা হয়। এ সময় আরডিসি বারবার আরেকজনকে বলছিলেন, ডিসি স্যারকে ফোন দাও, মেসেজ দাও। কী করবো সেটা বলতে বলো?
রিগ্যানের স্ত্রী মুসতারিমা সরদার নিতু জানান, আমার স্বামীকে মেরে ফেলার জন্যই অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। হাসপাতালের বেডে সে কাতরাচ্ছে। আমি তার সুচিকিৎসার আবেদন জানাচ্ছি। আমার স্বামীর কাছে ৪টি সিগনেচার নেয়া হয়েছে, সেটি যেন অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি। একই সাথে মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানান নিতু।
আরিফুল ইসলাম কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের আরডিসির নাম নয়া দিগন্তের কাছে বলেছেন। কিন্তু অভিযোগগুলো যেহেতু খুবই গুরুতর, তাই ওই কর্মকর্তার বক্তব্যের জন্য তার মোবাইল ফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। প্রতিবারই তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে ওই কর্মকর্তার নাম উহ্য রাখা হলো।
তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে
সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কারাদণ্ড দেয়ার ঘটনায় গঠিত রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার বেলা পৌনে তিনটায় মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনসহ তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
রংপুর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সার্বিক জাকির হোসেন জানান, রোববার বেলা পৌনে তিনটায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে বিধিবহির্ভূতভাবে রাতে ওই বাড়িতে হামলা চালিয়ে সাংবাদিক আরিফুলকে ধরে নিয়ে গিয়ে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তদন্তে বলা হয়েছে ডিসি সুলতানা পারভীন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং দুইজন ম্যাজিস্ট্রেট বিধিবহির্ভূতভাবে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগে মন্ত্রণালযের নির্দেশে শনিবার রংপুর বিভাগীয় কমিশনার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার রাজস্ব আবু তাহের মোঃ মাসুদ রানাকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেন।
তিনি শনিবার দুপুর থেকে রাত ২ পর্যন্ত আরিফের বাড়ি, ডিসি অফিস এবং কুড়িগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে তদন্ত করেন এবং তা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি পুরো তদন্ত প্রতিবেদনটি দুপুরে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেনের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপরই সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
হাইকোর্টে রিট
এদিকে রোববার সকালে আরিফুল ইসলামকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে কারাদণ্ড দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ১৭ জনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশীদের পক্ষে আইনজীবী ইশরাত হাসান।
আবেদনের প্রাথমিক শুনানি হয়েছে রোববার বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ইশরাত হাসান ও ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য। রিটে ফৌজদারি কার্যবিধি, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন এবং সংবিধানের ৩১,৩২,৩৫ এবং ৩৬ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
কুড়িগ্রামের ডিসি প্রত্যাহার
রোববার দুপুরে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বাড়িতে মধ্যরাতে হানা এবং তাকে তুলে নেয়ার ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনের সম্পৃক্ততা ও আচরণের অসঙ্গতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এজন্য তাকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, শুধু ডিসি নয়, এই ঘটনার সাথে অন্য যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিল, নিজ নিজ ভূমিকা বিবেচনায় নিয়ে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। জনমনে শনিবার থেকে যত প্রশ্ন উঠেছে, সব প্রশ্নের সত্যতা তদন্তে পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, এক-দুজন কর্মকর্তার দায় সরকার বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নেবে না। তিনি বলেন বিভাগীয় কমিশনারের খসড়া প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। তাতে আইন না মেনে মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, প্রশাসন সম্পর্কে জনগণকে ভীতির জায়গায় নিয়ে যাওয়া। অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টি করায় জনমনে বিরূপ ধারণা জন্ম দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।
এদিকে রিগ্যানের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার, সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণ এবং ডিসি সুলতানা পারভীনসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে সোমবার রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে সাংবাদিকরা। বাংলা ট্রিবিউনের রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি লিয়াকত আলী বাদল সকল সাংবাদিককে যথাসময়ে উপস্থিত থাকার আহবান জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে কুড়িগ্রাম ডিসি অফিসের দুই-তিন জন ম্যাজিস্ট্রেট ১৫-১৬ জনআনসার সদস্যকে নিয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানের বাড়িতে গিয়ে তাকে মারধর করে টেনে হেচড়ে ডিসি অফিসে নিয়ে আসেন এবং সেখানে আনার পর কথিত দেড়শ গ্রাম গাঁজা ও আধা বোতল মদ রাখার দায়ে তাকে একবছরের জেল দিয়ে কারাগারে পাঠান। এ ঘটনা এখন বিশ্বব্যাপি আলোচিত হচ্ছে। প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ।