শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন

সখীপুরে দেড় মাসে ৫ খুন

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
  • ৪৯ বার

টাঙ্গাইলের সখীপুরে দেড় মাসে কমপক্ষে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রতিনিয়ত খুনের ঘটনা বাড়ায় আতঙ্কে সখীপুরের বাসিন্দারা। খুন হওয়া মানুষের মধ্যে যেমন আছেন বৃদ্ধ, তেমন ছোট শিশুও রয়েছে।  এছাড়া প্রায় প্রতিরাতেই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সিঁধ কেটে, টিন কেটে বা ঘরের দরজা ভেঙে চুরির ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় অনিরাপদ বোধ করছে স্থানীয় লোকজন।

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার দুপুরে সামিয়া (৯) নামে তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দুপুর ১টায় বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বনের ভেতর একটি ড্রেন থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে গত বুধবার স্কুল থেকে ফেরার পথে তাকে অপহরণ করা হয়।

এর আগে আরো চারটি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

ব্যবসায়ী চাচা-ভাতিজা খুন

গত ২০ জুলাই সখীপুরের কাকড়াজান ইউনিয়নের বাঘেরবাড়ি এলাকায় দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। একইদিন ভোরে স্থানীয়রা লাশ দু’টি দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। নিহতরা হলেন সখীপুর উপজেলার কাকড়াজান ইউনিয়নের বাঘেরবাড়ি গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে শাহজালাল (৩৫) ও নবু মিয়ার ছেলে মজনু মিয়া (৪৫)।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, শাহজালাল বাঘেরবাড়ি বাংলা বাজারে মুদি দোকান ও বিকাশের ব্যবসা করত। রাতে দোকান বন্ধ করে ওই দুই ব্যবসায়ী বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়। পরে তারা আর বাড়িতে ফিরেনি। মধ্যরাতে তারা একটি নির্জন স্থানে পৌছালে, দুর্বৃত্তরা তাদের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। সকালে স্থানীয়রা লাশ দু’টি দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। লাশ দু’টির পাশে তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি পড়ে ছিল।

এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মোস্তফা মিয়া (২০) ও আল আমিন (২৭) নামে দু’জনকে গ্রেফতার করে র‍্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে র‍্যাব বলছে, ঋণের টাকা পরিশোধ করতেই এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। ৩ আগস্ট সখীপুর ও ঢাকার মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

কিশোরীর লাশ উদ্ধার

গত ১৩ আগস্ট রাত ৮টার দিকে সখীপুর উপজেলার কাঁকড়াজান ইউনিয়নের ছোটচওনা গ্রামের একটি পোল্ট্রি খামারের পাশ থেকে আলমিনা আক্তার নামে এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। আলমিনা ওই ইউনিয়নের ছোটওচনা গ্রামের হারুন মার্কেট এলাকার আলহাজ মিয়ার মেয়ে। ওই কিশোরী মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল বলে তার বাবা জানান।

কিশোরীর পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১২ আগস্ট রাত ১০টার দিকে আলমিনা তার দাদার একটি ঘরে ঘুমাতে যায়। রোববার সকালে তাকে আর সেখানে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলমিনাকে না পেয়ে এলাকায় মাইকিং করা হয়। পরে রাত ৮টার দিকে খবর আসে স্থানীয় একটি পোল্ট্রি ফার্মের পাশে আলমিনার লাশ পাওয়া গেছে। খবর পেয়ে সখীপুর থানা পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।

কিশোরীর বাবা আলহাজ মিয়া জানান, তার মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। মেয়ের মৃত্যুতে কারো বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই।

তবে কিশোরী আলমিনার দাদা আবদুল আজিজের দাবি তাকে কেউ হত্যা করেছে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আলমিনা কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। তবে চিকিৎসা করানো হয়েছে, এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার নাতনির খুনিকে ধইরা দিতে হবো, খুনির উপযুক্ত বিচার করতে হবো। খুন কইরা যারা এখানে ফালাইয়া রাখছে আমি তাগো উপযুক্ত বিচার চাই। এ ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।’

বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার

গত ৪ সেপ্টেম্বর (সোমবার) দুপুরে সখীপুরের হতেয়া উলিয়ারচালা গ্রাম থেকে নিখোঁজের একদিন পর বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জমি থেকে আরফান আলী (৬০) নামের এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ওই এলাকার মৃত কুরবান আলীর ছেলে।

নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, আরফান আলী গত ৩ সেপ্টেম্বর (রোববার) বিকেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে আর ফিরেননি। তার পরিবার বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে। পরদিন দুপুরে পরিত্যক্ত জমিতে তার লাশ দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে। এ ঘটনায়ও এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়ার লাশ উদ্ধার

শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১টায় বাড়ি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে বনের ভেতর একটি ড্রেন থেকে সামিয়া (৯) নামে তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করে সখীপুর থানা পুলিশ। সামিয়া উপজেলার দাড়িয়াপুর গ্রামের রঞ্জু মিয়ার মেয়ে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বাবা রঞ্জু মিয়া সখীপুর থানায় মামলা করেন।

পুলিশ ও সামিয়ার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সকাল ৭টায় ওই ছাত্রী বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রাইভেট পড়তে যায়। প্রাইভেট পড়া শেষ হলে সহপাঠীদের সঙ্গে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হয়। পথে একটি দোকানে সহপাঠীরা কেনাকাটা করতে দাঁড়ালে সে একাই বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। এদিকে বাড়ি ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় মা রুপা বেগম শিক্ষককে ফোন দিয়ে জানতে পারেন তার মেয়ে অনেক আগেই চলে গেছে।

পরে মা মেয়েকে খুঁজতে বের হলে বাড়ির কাছাকাছি একটি স্থানে মেয়ের ব্যবহৃত জুতা পড়ে থাকতে দেখেন। এর কিছুক্ষণ পর তার মোবাইল ফোনে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে একটি অডিও বার্তা আসে।

অডিও বার্তায় বলা হয়, ‘আসসালামু আলাইকুম। আপনার মেয়ে ভালো আছে। টাঙ্গাইলে আছে, আজকের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা দিলে মেয়ে পাবেন। বিষয়টি পুলিশ ও এলাকার কাউকে জানাবেন না। জানালে আপনার মেয়ের ক্ষতি হবে। এরপর শুক্রবার দুপুরে সামিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়।

শিশু সামিয়ার সাথে ঘটে যাওয়া হৃদয় বিদারক ঘটনায় অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে শঙ্কা বোধ করছেন। অনেকে মনে করছেন, অন্য জায়গার চেয়ে সখীপুরে অপরাধ করে পার পাওয়া যায় সহজে। পূর্বের ঘটনার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের যথাযোগ্য বিচার না হওয়াই পরের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কারণ বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

এছাড়া সখীপুর ধোপার চালা স্বপ্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক জুবায়ের সিকদার অব্যাহত এসব হত্যার ঘটনার পেছনে সখীপুরে মাদকের সহজলভ্যতাকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, মাদকের কারণেই সখীপুর এমন নেতিবাচকভাবে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। অপরাধ নির্মুল করতে হলে আগে মাদক নির্মুল করতে হবে।

হত্যা, চুরিসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে পুলিশ, চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং শিক্ষকসহ দায়িত্বশীল সবার সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদ দিয়ে সখীপুর পিএম পাইলট গভঃ স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক কেবি খলিলুর রহমান বলেন, পুলিশ সদস্যরা সবার বাড়িতে গিয়ে তো নজরদারি করতে পারবেন না। একটা থানায় কতজনই বা পুলিশ সদস্য থাকেন। আমাদের নিজেদের সচেতনতাও জরুরি।

তিনি বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ মোবাইল গেমসের পাশাপাশি ভার্চুয়াল জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। আমরা শিক্ষকরাই তাদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছি। এ কারণে সবার সচেতন হতে হবে। একজন মানুষ একদিনেই অপরাধ প্রবণ হয় না। নিজের সন্তান কখন কী করছে, কার সাথে মিশছে, এসব ভালোভাবে লক্ষ রাখতে হবে। তাহলে গোড়া থেকেই অপরাধ নির্মুল করা সম্ভব।

সখীপুর রাবেয়া বাহার মহিলা মাদরাসার শাইখুল হাদীস এবং ভালুকা ধাইরাপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি হাবিবুল্লাহ বলেন, হত্যা ও চুরির ঘটনাসহ সব ধরনের অপরাধ দমনের জন্য প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা জরুরি। পাশাপাশি সামাজিকভাবে সচেতনতা, বিশেষ করে উপজেলার প্রত্যেক মসজিদে অপরাধ প্রবণতার বিষয়ে আলোচনা দরকার। মোট কথা, সখীপুরে অব্যাহত হত্যাকাণ্ডসহ সবধরনের অপরাধ যেহেতু বৃদ্ধি পেয়েছে, সুতরাং এটা আমাদের জন্য সামাজিক অবক্ষয়ই মনে করতে পারেন। আর সামাজিক অবক্ষয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।

মুফতি হাবিবুল্লাহ আরো বলেন, ছোট হোক বা বড় যেকোনো ধরনের অপরাধ দেখলে পুলিশকে জানাতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। কাউকে জুয়া খেলতে বা মাদক গ্রহণ করতে দেখলেও প্রশাসনকে অবহিত করতে হবে। তাহলেই অপরাধ দমন করা যাবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com