নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অর্থাৎ সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে এরই মধ্যে আমাদের দেশ ভারতে ব্যাপক অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক প্রভৃতি রাজ্যে প্রতিবাদী বিক্ষোভে কম করে হলেও ৩২ জন নিহত হয়েছেন। এদের বেশির ভাগই তরুণ। দিল্লির জওয়াহেরলাল নেহরু ইউনির্ভাসিটি (জেএনইউ) ও জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া, আলিগড় এবং দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ ও বিজেপি সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তদের আক্রমণে বহু ছাত্রছাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন। কারো কারো অঙ্গহানি হয়েছে চিরতরে। এ ছাড়া আসাম, মণিপুর, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, চেন্নাই, মুম্বাইয়ের মতো জায়গাতেও বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। ফলে ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যের শিক্ষাঙ্গন ও অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এবার সংঘটিত উত্তর-পূর্ব দিল্লির নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বরামন্ত্রী অমিত শাহ এর উৎসের জন্য দায়ী করেছেন সিএএ বিরোধী আন্দোলনকে। তিনি বলেন, সিএএ আইন কোনো মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেবে, এমন কোনো ধারা উপধারা এই আইনে নেই। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকায় গিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন- এনআরসি, সিএএ… এগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।’ অর্থাৎ ভারত কোনো ব্যক্তিকে বাংলাদেশে বহিষ্কার করবে না। তবে বাংলাদেশ এই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারেনি। নয়াদিল্লি সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে এনআরসি ও সিএএ-এর বিষয়টি উল্লিখিত হোক। কিন্তু মোদি সরকার তাতে রাজি না হওয়ায় খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েই শেখ হাসিনা দেশে ফিরে গেছেন। সব মিলিয়ে বিষয়টি যে গুরুতর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এর মধ্যেই একটি সংবাদ পোর্টাল ‘ওয়ার ডট ইন’ আরটিআইয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহের পরিচালনাধীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে প্রশ্ন করেছিল, বিতর্কিত আইন সিএএ-এর সাথে যুক্ত সব ফাইল ও নথিপত্র সর্বজনীন অর্থাৎ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে কি না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু ঠুনকো যুক্তি দিয়ে এই ফাইলপত্রগুলো শুধু উন্মুক্ত করতেই অস্বীকার করেনি, সেই সাথে আরটিআই আইনে জবাব দেয়ার চূড়ান্ত সময়সীমারও উল্লঙ্ঘন করেছে। ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে দায়ের করা আরটিআইয়ের এই আবেদনে সেসব দস্তাবেজ, রেকর্ডস, ফাইল, নোটিশ, পত্র প্রভৃতি চাওয়া হয়েছিল, যাকে ভিত্তি করে এই আইন তৈরি করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় জনসূচনা অধিকারী তার জবাবে কোনো ধরনের তথ্য দিতে অস্বীকার করেন। তার বক্তব্য, ‘এ সম্পর্কে তথ্যাদি জনসমক্ষে প্রকাশ করলে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তাদের জবাবে লিখেছে, এই ফাইলগুলো বিদেশী নাগরিকদের নাগরিকতা প্রদানের নীতির সাথে যুক্ত। বলা হয়েছে, এই তথ্যাদি প্রকাশ করলে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, তাই আরটিআই অ্যাক্টের এক ধারা অনুযায়ী এই সম্বন্ধীয় কোনো তথ্য সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে তারা বাধ্য নন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসূচনা অধিকারী কোনো ন্যায্য কারণ প্রদান করেননি যে, এ ধরনের তথ্যাদি কার ক্ষতি করবে। আরো প্রশ্ন উঠেছে, দেশের জনগণ তথা নাগরিকদের এই তথ্যাদি দেয়া হয় যে, কিসের ভিত্তিতে কেবিনেট এই আইন পাস করার ফয়সালা করেছিল। কারণ সরকার বলেছে, ‘সিএএ এক উন্নত ও সার্থক গণতন্ত্র নির্মাণ করতে সহায়ক হবে আর সাধারণ জনগণের বিভিন্ন প্রয়োজনকে পুরো করবে।’
ভারত সরকার বরাবর এই আইনকে ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ মামলা’ বলে অভিহিত করেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বেশ কয়েকবার বলেছে, সিএএ মৌলিকভাবেই সম্পূর্ণ বিভেদকারী একটি আইন।’ এর দ্বারা ভারত আন্তর্জাতিক আইনকে উল্লঙ্ঘন করছে। কাজেই প্রশ্ন উঠেছে, ভারত যদি এ বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে মনে করে, তা হলে বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কথা কেন উঠছে? সিএএ-সংক্রান্ত দস্তাবেজ ও ফাইলে কী গোপন কথা রয়েছে, যা বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রকাশ পেলে ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ হবে? ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সিএএ আইনের পশ্চাতে কী রয়েছে, যা বিদেশী রাষ্ট্রগুলোকে ভারতের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলবে?
অন্য দিকে ৫ মার্চ ২০২০ সালে সাংসদ আহমদ হাসান (ইমরান) বিদেশমন্ত্রীর কাছে এক প্রশ্নে জানতে চেয়েছিলেন, ভারত যেহেতু সার্ক ফোরামের অগ্রণী সদস্য, সার্ক দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নে ভারত কী কী উদ্যোগ নিচ্ছে? নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অর্থাৎ সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে সার্ক দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কের কি কোনো অবনমন ঘটেছে? এই সম্পর্কে লিখিত জবাব দিতে গিয়ে ভারতের বিদেশপ্রতিমন্ত্রী শ্রী ভি মুরালিধরন বলেছেন, একমাত্র একটি রাষ্ট্র (পাকিস্তান) ছাড়া সার্কভুক্ত সব দেশের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযোগিতা রয়েছে। আর সিএএ এবং এনআরসির জন্য সার্ক সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনমন হয়েছে কি না, ইমরানের এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিদেশপ্রতিমন্ত্রী বলেছেন, উল্লিখিত এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাজেই সম্পর্ক অবনমনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’ আহমদ হাসান (ইমরান) পরে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিদেশমন্ত্রকের জবাবের দ্বারা রহস্য বরং আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সিএএ এবং এনআরসি সম্পর্কে তথ্যাদি প্রকাশ করলে তা কেন বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্কের ক্ষতি হবে?
এক দিকে বলা হচ্ছে, ‘এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আর তাই এ ব্যাপারে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক অবনমনের প্রশ্নই ওঠে না।’ অন্য দিকে বলা হচ্ছে, এ সম্পর্কিত তথ্য ও ফাইলপত্র নাগরিকদের কাছে উন্মুক্ত হলে তাতে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।’ কাজেই ভারত সরকারের উচিত আগেই স্থির করে নেয়া যে, বিপরীতমুখী এই বক্তব্যগুলোর কোনটিকে তারা সত্য বলে মনে করেন।