গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আইনি পথ বন্ধ হয়ে যায়নি এবং সরকার চাইলে মানবিক কারণে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় শর্তহীন মুক্তি দিয়ে তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর অনুমতি দিতে পারে। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে না দেখে মানবিকভাবে দেখলে আইনের বিধানে কোনো বাধা হবে না বলে আইনবিদরা মনে করেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার প্রয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এই ধারা সরকার প্রয়োগ করে। একবার এই ধারা প্রয়োগ করলে দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করা যাবে কিনা? বা শর্তযুক্ত মুক্তি দেয়ার পর শর্তহীন মুক্তি দেয়ার সুযোগ এই আইনে আছে কিনা? এই প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, রিভিউ করার জন্য আবেদন করা যাবে।
অন্য দিকে অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আইনি পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আইনের সঠিক ব্যাখা নয় বলে দাবি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা একজন গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি করা অমানবিক। তিনি বলেন, সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসার বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা (সরকার) খালেদা জিয়াকে ব্যবহার করে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে চায়। কিন্তু বেগম জিয়া আপসহীন নেত্রী। তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার বিধান অনুযায়ী সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে শর্তযুক্ত মুক্তি দিয়েছে। এখন ৪০১ ধারার বিধান অনুযায়ী শর্তহীন মুক্তি দিলে তিনি বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পারেন। তারা বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে দেখছে। আমরা মানবিকভাবে দেখার জন্য আবেদন করছি।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক মহসিন রশিদ বলেন, আইনমন্ত্রী একদম মিথ্যা বলছেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠতে কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, সরকার চাইলে যেকোনো সাজা স্থগিত বা মওকুফ করতে পারেন। এ ধারার বিধান অনুযায়ী শর্তহীনভাবে মুক্তি দিলে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসায় কোনো বাধা নেই। এখানে একবার ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার বিধান প্রয়োগ করলে আবার করা যাবে না এটাও ঠিক নয়।
মহসিন রশিদ বলেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আইনের বিধানে কোনো বাধা নেই। তিনি আরো বলেন, আল্লাহ না করুন, বেগম খালেদা জিয়া যদি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তা হলে এটা হবে প্রথম ডিগ্রির মার্ডার। আর এর জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে মামলা ও বিচারের মুখমুখি হতে হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৪০১(১) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে সরকার চাইলে একজন বন্দীর সাজা মওকুফ করতে পারে। সাজা কমাতে পারে, সাময়িকভাবে সাজা স্থগিত করতে পারে। শর্তযুক্ত বা শর্তমুক্ত মুক্তি দিতে পারেন। এখানে বেগম খালেদা জিয়াকে শর্তযুক্ত মুক্তি দিয়েছে। আমরা বলেছি শর্তমুক্ত মুক্তি দিলেই তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারেন। তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৪০১ (১) ধারায় অতীতে জেনারেল আজিজ সাহেবের ভাইকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ৪০১ (৬) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে সরকার চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো বন্দীর ক্ষেত্রে যেকোনো সিদ্ধান্ত দিতে পরে। এর আগে গত ৪ অক্টোবর সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেয়ার বিষয়ে আইনি পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, আইনি বিষয়টি এখন অতীত ও পুরোপুরি বন্ধ।
সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১(১) ধারায় সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাদণ্ড স্থগিত করার বিধানগুলো তুলে ধরেন। এবং ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১ ধারার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। ৪০১ (৬) ধারায় আদেশটা কিভাবে দেয়া হবে তাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আইনে শর্তযুক্ত ও শর্ত মুক্ত মুক্তির বলা আছে। শর্ত যদি দেয়া হয় যাকে দেয়া হচ্ছে তাকে তা মানতে হবে। এগুলো সম্পূর্ণ হয়ে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার আইনি কোনো সুযোগ আছে কিনা? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফেলেছেন। পুনরায় এ ক্ষমতা প্রয়োগের আর কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপতির কাছে তারা ক্ষমা চাইতে যাবে কিনা সে পরামর্শ আমি দিতে চাই না। তবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। খালেদা জিয়া চাইলে ক্ষমা চেয়ে সাজা মওকুফ করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারেন।
যা বলা হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় : ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা (১) উপধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয়, সেই শর্তে তার দণ্ড কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারবেন।
উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, যখন কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়, তখন যে আদালত উক্ত দণ্ড দিয়েছিলেন বা অনুমোদন করেছিলেন, সেই আদালতের প্রিজাইডিং জজকে সরকার ওই আবেদন মঞ্জুর করা উচিত কিংবা মঞ্জুর করতে অস্বীকার করা উচিত, সে সম্পর্কে তার মতামত ও মতামতের কারণ বিবৃত করতে এবং এই বিবৃতির সাথে বিচারের নথির নকল অথবা যে নথি বর্তমানে আছে, সেই নথির নকল প্রেরণ করার নির্দেশ দেবেন।
(৩)-এ বলা হয়েছে, যেসব শর্তে কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হয়েছে, তার কোনোটি পালন করা হয়নি বলে মনে করলে সরকার স্থগিত বা মওকুফের আদেশ বাতিল করবেন এবং অতঃপর যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত রাখা কিংবা মওকুফ করা হয়েছিল, সে মুক্ত থাকলে যেকোনো পুলিশ অফিসার তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন এবং তার দণ্ডের অনতিবাহিত অংশ ভোগ করার জন্য তাকে জেলে প্রেরণ করা যাবে।
উপধারা (৪)-এ বলা হয়, সেই শর্তে এই ধারার অধীন দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়, যা যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়, সেই ব্যক্তি পূরণ করবে অথবা শর্ত এমন হবে যা পূরণে সে স্বাধীন থাকবে।
(৪)-এর ক-তে বলা হয়, এই বিধি বা অন্য কোনো আইনের কোনো ধারা অনুসারে কোনো ফৌজদারি আদালত কোনো আদেশ দান করলে তা যদি কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে অথবা তার বা তার সম্পত্তির ওপর দায় আরোপ করে, তাহলে উপযুক্ত উপধারাগুলোর বিধান এই আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
উপধারা (৫)-এ বলা হয়, প্রেসিডেন্টের অনুকম্পা প্রদর্শন দণ্ড স্থগিত রাখা বা কার্যকরীকরণের বিলম্ব ঘটানো বা মওকুফ করার অধিকারে এই ধারার কোনো কিছু হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে করা যাবে না।
(৫)-এর ক-তে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট কোনো শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা মঞ্জুর করলে ওই শর্ত যে প্রকৃতিরই হোক না কেন, তা এই আইন অনুসারে কোনো উপযুক্ত আদালতের দণ্ড দ্বারা আরোপিত শর্ত বলে গণ্য হবে এবং তদানুসারে বলবৎযোগ্য হবে।
উপধারা (৬)-এ বলা হয়, সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখা এবং দরখাস্ত দাখিল ও বিবেচনার শর্তাবলি সম্পর্কে নির্দেশ দিতে পারবেন।
উল্লেখ্য, ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে শেষ চেষ্টা হিসেবে বিদেশে চিকিৎসার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়।
২০২০ সালের ২৫ মার্চ পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১ ধারায় সরকারের নির্বাহী আদেশে দুই মামলার কারাদণ্ড স্থগিত হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান। এরপর আরো ছয়বার বার তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালত। রায় ঘোষণার পর খালেদাকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়। এরপর একই বছরের ৩০ অক্টোবর এ মামলায় আপিলে তার আরো পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট।
এ ছাড়া একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালত।